হলুদ পোড়া গল্প বড় প্রশ্ন উত্তর // দ্বাদশ শ্রেণী চতুর্থ সেমিস্টার // Holud Pora Class 12 Long Question Answer // 4th Semester

হলুদ পোড়া গল্প বড় প্রশ্ন উত্তর // দ্বাদশ শ্রেণী চতুর্থ সেমিস্টার // Holud Pora Class 12 Long Question Answer // 4th Semester

হলুদ পোড়া গল্প বড় প্রশ্ন উত্তর

5 মার্ক প্রশ্ন উত্তর

(১) “দুটি খুনের মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করার জন্য প্রাণ সকলের ছটফট করে”- কোন দুটি খুনের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে ? সম্পর্ক আবিষ্কার করার জন্য সকলের প্রাণ ছটফট করার কারণ পর্যালোচনা করো। ২+৩=৫

উত্তর:

যে দুটি খুনের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার : উদ্ধৃত অংশটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘হলুদ পোড়া’ নামক গল্পসংকলনের প্রথম গল্প ‘হলুদ পোড়া’ থেকে গৃহীত। সে বছর কার্তিক মাসের মাঝামাঝি গাঁয়ে তিন দিন আগে পরে দু-দুটো খুন হয়। প্রথমে খুন হয় মাঝবয়সী জোয়ান ও অত্যাচারী পুরুষ বলাই চক্রবর্তী এবং পরে খুন হয় আপাত নিরীহ ষোলো-সতেরো বছরের এক রোগা ভীরু মেয়ে শুভ্রা। গ্রামবাসী এই দুই খুনের মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টায় ছটফট করছিল।

খুন দুটির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার কারণ : আপাত শান্ত গাঁয়ে বিগত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে কেউ সেভাবে সেখানে জখম পর্যন্ত হয়নি-এমন জায়গায় তিন দিন আগে পরে দু-দুটো খুনের ঘটনা গ্রামবাসীকে এমনিতেই নাড়া দিয়েছিল। তবে খুন হওয়া দুজনের মধ্যে একজন পুরুষ অপরজন নারী। এখানেই লুকিয়ে আছে সকলের প্রাণ ছটফটানি কারণ। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সামাজিক নানা ভালো-মন্দ, অপসংগতি, সুসংস্কার সব কিছুই সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় বলা চলে, লেখকরা তা করে থাকেন। এক্ষেত্রে লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যবিত্ত জীবনের বিকৃতি ও কৃত্রিমতা-যা তাঁর কাছে মনে হত অসহ্য সেগুলিকেই তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। তিনি এই বিকৃতিকে মনেপ্রাণে ধ্বংস করতে চাইতেন কিন্তু পথ না-পেয়ে এই বিকৃতিকে বড়ো করে দেখাতেন, যাতে করে সমাজ তার আপন ক্ষতের মলম আপনিই জোগাড় করে নিতে পারে। আসলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেন এই গল্পে মধ্যবিত্ত মননকে ব্যঙ্গের কশাঘাত করেছেন-তাই তাদের মধ্যে দুটো খুনের মধ্যে সম্পর্ক কী?-এই চিন্তাভাবনায় লহর তুলেছেন এবং তিনি তাতে সফলও হয়েছেন।

(২) “তবে কথাটাকে সে ঘুরিয়ে দিল একটু অন্যভাবে, যার ফলে অবিশ্বাসীর মনে পর্যন্ত খটকা বাধা সম্ভব হয়ে উঠল।”কোন কথার কথা বলা হয়েছে ? কথাটি কে, কীভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছিল তা লেখো। ৩+২=৫

উত্তর:

প্রশ্নোদ্ভৃত ‘কথার’ প্রসঙ্গে : উদ্ধৃতাংশটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পের অংশবিশেষ। তিন দিন আগে পরে গাঁয়ে বলাই চক্রবর্তী ও শুভ্রার খুনের একুশ দিনের মাথায় বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো নবীনের স্ত্রী দামিনীর ওপর অশরীরী আত্মা ভর করে। অশরীরী আত্মাকে ছাড়াতে কুঞ্জ গুণীনকে ডেকে পাঠানোর আগেই সে লোকমুখে সে-কথা শুনে সেখানে হাজির হয়। কুঞ্জ হাজির হয়েই “ভর সাঝে ভর করেছেন, সহজে ছাড়বে লা” বলে সকলের মনে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর সে তার গুণপনা শুরু করে। দুর্বোধ্য সব মন্ত্র উচ্চারণ করে, দামিনীর এলোচুল খুঁটির সাথে শক্ত করে বেঁধে, মালসায় আগুন ধরিয়ে, হলুদ পুড়িয়ে নাকে শুঁকিয়ে এভাবে তার ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চলে এবং সাথে সাথে প্রশ্নও চলে সে কে? যখন উত্তর আসে-শুভ্রা। তখনই তার খুনি কে জানতে চাইলে উত্তর আসে বলাই চক্রবর্তী। দামিনীর মুখে শুভ্রা বলাই চক্রবর্তীর নাম করায় কুঞ্জের ওপর বিশ্বাসীদের আস্থাতে খটকা লাগে কারণ বলাই চক্রবর্তী যেহেতু শুভ্রার তিন দিন আগে খুন হয়েছিল। এখানে সে-কথাই বলা হয়েছে।

কথাটি যে যেভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছে: গ্রামবাসীদের কুঞ্জের ওপর অনাস্থাতে আসরে নামে বুড়ো ঘোষাল। তার কথায় শুধু জ্যান্ত মানুষই গলাটিপে মারে না। শ্মশানে-মশানে আরও কতকিছুতেই তো ঘাড় মটকে মারে। এরপরেই কুঞ্জ সম্মান বাঁচাতে আসরে নামে। তার কথায় বলাই চক্রবর্তী শুভ্রাকে সরাসরি খুন করেনি; পরোক্ষভাবে কারোর ওপর তার রক্তমাংসের হাত দিয়ে খুন করেছে। ব্যাখ্যা হিসেবে কুঞ্জ বলে মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে শ্রাদ্ধ-শান্তি না-হলে আত্মা সরাসরি খুন করতে পারে। এক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি বলে বলাই চক্রবর্তী পরোক্ষভাবে খুন করেছে-এ কথার দ্বারা উপস্থিত মানুষের বিশ্বাসের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ পড়েছিল।

(৩) ছোটোগল্প হিসেবে ‘হলুদ পোড়া’ গল্পটি কতদূর সার্থক তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো। [সংসদ নমুনা প্রশ্ন] ৫

উত্তর: ছোটোগল্পের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারিত না-হলেও সমালোচকরা কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন, যেমন-কাহিনির একমুখীনতা, ব্যঞ্জনধর্মীতা, শেষের মধ্যেও অশেষের সুর বেজে ওঠা প্রভৃতি। ছোটোগল্পের আকার ছোটো হবে, চরিত্র সংখ্যা কম থাকবে, জীবনের একটি খণ্ড ক্ষুদ্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্পটি গড়ে উঠবে এবং সেই একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে সমগ্রজীবন প্রতিভাসিত হয়ে উঠবে।

আপাত শান্ত গ্রামে তিন দিনের ব্যবধানে একজন জোয়ান-মদ্দ ও একজন শান্ত ঘরোয়া মেয়ের খুন হয়ে যাওয়ায় গ্রামবাসীদের মধ্যে ভীতি ও কৌতূহল উদ্রেক করে। এর দিন-কুড়ি পরে সদ্য গ্রামে আসা দামিনী নামের এক মহিলা অশরীরী আত্মার দ্বারা আক্রান্ত হয়; ফলে গ্রামবাসীরা আলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়। গ্রামের নাম করা কুঞ্জ গুণিনের গুণপনায় আবিষ্কৃত হয় প্রথমে খুন হওয়া বলাই-ই নাকি ঘরোয়া নিরীহ মেয়ে শুভ্রার খুনি। কথাটা চাউর হয়ে যাওয়ার পরপরই বিজ্ঞানের ছাত্র ও স্থানীয় স্কুলশিক্ষক ধীরেন লোকলজ্জা ও মানসিক টানাপোড়েনে একসময় কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে মৃতা বোন শুভ্রার আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে এবং ভৌতিক শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়; এবারও কুঞ্জ গুণিনের আগমন ঘটে। কুঞ্জ তার নাকের কাছে হলুদ পোড়া শোঁকায় এবং গল্প নাটকীয় মোড় নেয়। শুভ্রার আত্মার সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে বলাই এবং আত্মার সংযোগ স্থাপিত হয়; তাই সে নিজেকে বলাই চক্রবর্তী বলে পরিচয় দেয় এবং স্বীকার করে সে-ই শুভ্রার খুনি।

অলৌকিকত্বের মোড়কে লেখক মধ্যবিত্ত মননের অবচেতন স্তরের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিসরটি ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবমনের বিকারগ্রস্ততা গল্পমধ্যে তুলে ধরেছেন ঠিকই, কিন্তু খুনের রহস্যাবৃত দিকটি উন্মোচিত না-করে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, যা পাঠকচিত্তে অনুরণিত হতে থাকে-গল্পের পরিসমাপ্তিতে তাই অতৃপ্তির রেশ এখানেও বর্তমান। সামগ্রিকভাবে ছোটোগল্পের নানান লক্ষণ নিয়ে গল্পটি সার্থক ও শিল্পসমৃদ্ধ হয়েছে।

(৪) “ছি, ওসব দুর্বুদ্ধি কোরো না নবীন। আমি বলছি তোমায়, এটা অসুখ, অন্য কিছু নয়।” -নবীন কে ? বক্তা কোন দুর্বুদ্ধির কথা বলেছে ? তার এমন মনে হওয়ার কারণ কী ? ২+৩=৫

উত্তর:

নবীনের পরিচয় মানিক : বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পে কোনো এক কার্তিক মাসের মাঝামাঝি খুন হয়ে যাওয়া মাঝবয়সি জোয়ান-মদ্দ বলাই চক্রবর্তীর একমাত্র উত্তরাধিকারী অর্থাৎ তার ভাইপো হল নবীন। কাকার মৃত্যুর পর সে চল্লিশ টাকার চাকরি ছেড়ে শহর থেকে সপরিবারে গাঁয়ে এসে বসবাস করতে শুরু করেছে শুধুমাত্র কাকার সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও ভোগ করার জন্য।

দুর্বুদ্ধির প্রসঙ্গ এবং তাকে দুর্বুদ্ধি মনে হওয়ার কারণ :  উদ্ধৃত অংশটির বক্তা হল নবীনের বাল্যবন্ধু ধীরেন। নবীন গ্রামে এসে থাকার একুশ দিনের মাথায় অর্থাৎ তার কাকার মৃত্যুর একুশ দিন পর এক সন্ধ্যায় তার স্ত্রী দামিনী যখন রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরে যাচ্ছিল তখন সে উঠোনে আছড়ে পড়ে এবং তার দাঁতে দাঁত লেগে যায়, এক অদ্ভুত আওয়াজ করতে থাকে। দামিনীর চিকিৎসার জন্য গাঁয়ের ডাক্তারি পাস না-করা ধীরেন ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়। ধীরেনের আসার আগেই প্রতিবেশীরা জল ঢেলে ঢেলে তার মূর্ছা ভেঙেছে। কিন্তু ধীরেন এসে দেখল দামিনী অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, আপন মনে হাসছে কাঁদছে এবং যাকে তারা ধরে রেখেছিল তাদের সে আঁচড়ে কামড়ে পালাবার চেষ্টা করছে। ধীরেন রোগীর লক্ষণ দেখে কিছু বুঝলেও পাস করা নয় বলে চিকিৎসা করল না। সে ‘শা’ পুরের কৈলাশ ডাক্তারকে ডাকার পরামর্শ দিল। ততক্ষণে সেখানে অনেকের সাথে এসে হাজির হয় বলাই চক্রবর্তীর অন্নপুষ্ট বুড়ো পঙ্কজ ঘোষাল। সে ছাড়া আরও অনেকেই নবীনকে ওঝা কুঞ্জকেই ডাকার পরামর্শ দেন। ধীরেন নবীনকে বলে “লেখাপড়া শিখেছ, জ্ঞান-বুদ্ধি আছে, তুমিও কি ব’লে কুঞ্জকে চিকিৎসার জন্য ডেকে পাঠাবে?” নবীন কাকার পরিচিত পঙ্কজ ঘোষালের কথা ফেলতে না-পেরেও অনুগ্রহলব্ধ ব্যক্তিদের কথায় কুঞ্জ ও কৈলাশ ডাক্তার দুজনকেই ডাকতে পাঠায়, সেইসময় নবীন পঙ্কজ ঘোষালকে ‘কুঞ্জ কতো নেয়’ জিজ্ঞেস করে। এ কথা শুনে লেখাপড়া জানা যুক্তিবাদী ধীরেন এই দুর্বুদ্ধির কথা বলে। কারণ ধীরেন জানত যে এটা একটা খাপছাড়া অসুখ ছাড়া অন্য কিছু না।

হলুদ পোড়া গল্প বড় প্রশ্ন উত্তর
হলুদ পোড়া গল্প বড় প্রশ্ন উত্তর

(৫) “সে-বছর কার্তিক মাসের মাঝামাঝি তিন দিন আগে-পরে গাঁয়ে দু’দুটো খুন হয়ে গেল।”কোন্ দুজন, কীভাবে খুন হয়েছিল ? তাদের দুজনের খুন নিয়ে এলাকাবাসীদের প্রতিক্রিয়া সংক্ষেপে বিবৃত করো। ২+৩=৫

[অথবা],

চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেল”- কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চারিদিকে হইচই পড়ে যায়?

উত্তর:

যারা, যেভাবে খুন হয়েছিল :  উদ্ধৃত অংশটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পের অন্তর্গত ‘হলুদ পোড়া’ নামক একটি বিশিষ্ট গল্প থেকে গৃহীত।

ভৌতিক সংস্কারকে নিয়ে লেখা মনস্তাত্ত্বিক এই গল্পে যে দুজনের খুনের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম জন হল-মাঝবয়সি জোয়ান-মদ্দ পুরুষ যার নাম বলাই চক্রবর্তী; সমাজে যে অত্যাচারী বলেই পরিগণিত। তাকে কেউ বা কারা খুব সম্ভবত লাঠির আঘাতে মাথাটা আটচির করে মৃত্যু নিশ্চিত করে গাঁয়ের দক্ষিণে ঘোষেদের মজাপুকুরের ধারে ফেলে গিয়েছিল। আর অন্যজন হল গৃহস্থ ঘরের সাধারণ ঘরোয়া মেয়ে, বছর দেড়েকের বিবাহিতা ও সন্তানসম্ভবা আপাত নিরীহ মেয়ে শুভ্রা; যাকে কেউ বা কারা গলাটিপে মেরে বাড়ির পিছনে ডোবার ঘাটের কাছে ফেলে যায়।

উদ্দিষ্ট দুজনের খুনে এলাকাবাসীদের প্রতিক্রিয়া: তাদের দুজনের মধ্যে প্রথম জন বলাই চক্রবর্তীর খুন হওয়াকে কেন্দ্র করে চারিদিকে বিস্তর হইচই পড়ে গেলেও আপামর লোকজন খুব একটা বিস্মিত হয়নি, বরং বলা যায় যে বলাই চক্রবর্তীর এরূপ অপমৃত্যু বোধ করি আশেপাশের দশটা গাঁয়ের লোক মনে মনে কামনাই করেছিল। আর অন্যজন অর্থাৎ গৃহস্থ ঘরের মুখচোরা, বছর দেড়েকের বিবাহিতা ও সন্তানসম্ভবা শুভ্রার খুন হওয়া নিয়ে হইচই কম হলেও মানুষের বিস্ময় ও কৌতূহল ছিল অন্তহীন। যে মেয়েটিকে গাঁয়ের লোক চোখের সামনে আর-দশটা মেয়ের মতো বেড়ে উঠতে দেখেছে, বিয়ে হয়েছে, শ্বশুর বাড়ি গিয়েছে এবং রেয়াজ অনুযায়ী সন্তান প্রসবের জন্য বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে প্রত্যক্ষ করেছে; পাশের বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত যার মধ্যে খাপছাড়া কোনো লুকোনো জিনিস খুঁজে পায়নি-এহেন মেয়েকে গলাটিপে মেরে রেখে যাবে কেউ বা কারা-তা ভেবে উঠতে না-পেরে গাঁ সুদ্ধ লোক অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। তবে অজপাড়া-গাঁতে দুটো খুনের মধ্যে একটা কাল্পনিক যোগাযোগ ঘটিয়ে নানা রসাল কাহিনি সৃষ্টি হবে এবং মুখে মুখে জল্পনা-কল্পনা দেখা দেবে সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

(৬) “একটুখানি বাস্তব সত্যের খাদের অভাবে নানাজনের কল্পনা ও অনুমানগুলি গুজব হয়ে উঠতে উঠতে মুষড়ে যায়।”– ‘বাস্তব সত্যের খাদ’ বলতে গল্পে কী ইঙ্গিত করা হয়েছে ? ‘বাস্তব সত্যের খাদ’ কীভাবে কল্পনা ও অনুমানগুলিকে গুজব হয়ে ওঠা থেকে বিরত করেছিল-তা গল্প অবলম্বনে বিবৃত করো। ২+৩=৫

উত্তর:

বাস্তব সত্যের খাদ: উদ্ধৃত অংশটি ভৌতিক সংস্কারকে নিয়ে লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ নামক মনস্তাত্ত্বিক গল্প থেকে গৃহীত। ‘বাস্তব সত্যের খাদ’ কথাটি লেখক ব্যবহার করেছেন তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসী পরপর ঘটে যাওয়া বলাই চক্রবর্তী ও শুভ্রার খুনের মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করে মুখরোচক গুজব বানানোর চেষ্টায় মশগুল। কিন্তু এটাও সত্য যে, বলাই চক্রবর্তী ও শুভ্রার কবে সামনাসামনি দেখা হয়েছিল সেটা গ্রামবাসী কেউ-ই স্মরণ করতে পারছিল না। তাই গুজবটার দানা বাঁধাতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এই সামান্য সত্যটুকু।

কল্পনা ও অনুমানকে গুজব হয়ে ওঠা থেকে বিরত করতে ‘বাস্তব সত্যের খাদ’: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমাজের নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্যে যে রহস্য লুকিয়ে থাকে তা উদ্‌ঘাটনে ছিলেন অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। গ্রামজীবনে ভৌতিক কুসংস্কারে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তারই এক অনুপম মনস্তাত্ত্বিক গল্প আমাদের পাঠ্য গল্পটি। – ভৌতিক সংস্কারের ওপর আলোকপাত করে লেখা এমন গল্প বাংলা সাহিত্যে – সত্যিই দুর্লভ। অত্যাচারী বলাই চক্রবর্তীর নৃশংসভাবে খুন হয়ে যাওয়ার পর – গাঁয়ে হইচই হলেও বিশেষভাবে কেউ বিস্মিত হয়নি। তবে গৃহস্থ ঘরের সাধারণ মেয়ে শুভ্রার খুন হওয়ার পর গাঁ সুদ্ধ লোক যেন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। তবে যেহেতু একটি পুরুষ ও একটি যুবতী নারী খুন হয়েছে তাই গ্রামবাসী দুটি খুনের মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করার জন্য প্রায় উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে কিন্তু তাদের চিন্তায় যখন উঠে আসে যে, বলাই চক্রবর্তী শুভ্রাকে কবে শুধু চোখের দেখা দেখেছিল-তা গাঁয়ের কেউ মনে করতে পারে – না। ঠিক তখনই তাদের কল্পনা ও অনুমানগুলি গুজব হয়ে উঠতে উঠতে মুষড়ে পড়ে। এ যেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যে সামান্যতম আলোর – দ্যুতি। এই সত্যটিকে লেখক ‘বাস্তব সত্যের খাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

(৭) “দাওয়াটি যেন স্টেজ,”- কোন দাওয়ার কথা বলা হয়েছে ? দাওয়াটিকে লেখক স্টেজের সাথে তুলনা করেছেন কেন তা ঘটনাক্রম অবলম্বনে বর্ণনা করো। ২+৩=৫

উত্তর:

দাওয়ার বর্ণনা : উদ্ধৃতাংশটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্প থেকে গৃহীত। সদ্য খুন হয়ে যাওয়া বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো নবীনের স্ত্রী দামিনীর ওপর অশরীরী আত্মা ভর করে (গুণিন ও গ্রামবাসীদের মতে); ধীরেন ডাক্তার যাকে খাপছাড়া অসুখ বলেছে। এই আত্মা ভর করা বা খাপছাড়া অসুখ দূর করতে আসে এলাকার নামকরা গুণিন কুঞ্জ। সে এসেই উপস্থিত উৎসুক প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলে; “ভর সাঁঝে ভর করেছেন, সহজে ছাড়বেন না।“ তারপর সে সকলকে দাওয়া থেকে উঠোনে নামায় এবং মন্ত্র – পড়ার সাথে সাথে জল ছেটাতে থাকে। দাওয়ারই একটা খুঁটিতে দামিনীর – এলো চুল শক্ত করে বেঁধে দেয়। নবীনের এই দাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

দাওয়াটিকে স্টেজের সঙ্গে তুলনার অনুষঙ্গ : স্টেজ বা মঞ্চে প্রধানত কোনো নাটক বা দৃশ্য অভিনীত হয় এবং স্বাভাবিকভাবে নাটক দেখাকে কেন্দ্র করে দর্শকদের সেক্ষেত্রে আগ্রহের অন্ত থাকে না। এক্ষেত্রেও নবীনের দাওয়ায় তার স্ত্রীকে নিয়ে অশরীরী আত্মা ভর করার অজুহাতে কুঞ্জ যে কাণ্ডকারখানা বাঁধিয়েছিল তা নাটকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কুঞ্জ গুণিন ইতিমধ্যে দামিনীর চুল দাওয়ার খুঁটিতে বেঁধে দিয়েছিল। এখন সে এক পা সামনে এগিয়ে পাশে সরে, পিছু হটে, সামনে পিছনে দুলে দুলে দুর্বোধ্য মন্ত্র আওড়াতে থাকে। মালসাতে আগুন করে তাতে শুকনো পাতা, শিকড় ইত্যাদি পোড়াতে থাকে যার উৎকট গন্ধে দামিনীর আর্তনাদ ও ছটফটানি ধীরে ধীরে কমে আসে এবং সে বোজা বোজা চোখে কুঞ্জর দিকে নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তখন কুঞ্জ একটা হলুদ পুড়িয়ে দামিনীর নাকের কাছে ধরলে তার সর্বাঙ্গে শিহরন বয়ে যায়। তখন কুঞ্জ তাকে “কে তুই? বল, তুই কে?” প্রশ্ন করলে সে বলে-“আমি শুভ্রা গো, শুভ্রা।” এবং তাকে যে বলাই চক্রবর্তী খুন করেছে সে কথাও সে বলে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাওয়ার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন নারী-পুরুষ কুঞ্জর এই অশরীরীকে নিয়ন্ত্রণের দৃশ্য দেখতে থাকল। কুঞ্জ যেন তার আমদানিকৃত জ্ঞানবুদ্ধির অতীত রহস্যকে সহজবোধ্য করে যে উপস্থাপন করছে; তা ভয়-ডর ভুলে সকলেই প্রত্যক্ষ করতে থাকে-যা জ্ঞানবুদ্ধির অতীত; দাওয়া যেন নাটকের এক স্টেজে পরিণত হয়।

(৮) “আমায় মেরো না।”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করো। বক্তার এরূপ করুন আর্তির কারণ আলোচনা করো। ২+৩=৫

উত্তর:

প্রসঙ্গ: প্রখ্যাত সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনী বৈশিষ্ট্য হল-তিনি তাঁর তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমাজের নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্য উদ্‌ঘাটনে ছিলেন তৎপর। মনোবিশ্লেষণের যে তীক্ষ্ণতার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ তার বেশ কিছু নিদর্শন আমাদের পাঠ্য ‘হলুদ পোড়া’ গল্পে আছে। পরপর দুটো খুন হয়ে যাবার পর গ্রামবাসীদের মনোজগতের রহস্য লেখক এ গল্পে উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। গল্পে নবীনের স্ত্রী দামিনীর ওপর অশরীরী আত্মা ভর করে। এলাকার নামকরা গুণিন কুঞ্জ তা দূর করতে আসে এবং শুরু হয় সম্মোহিনী বিদ্যার সাথে শারীরিক অত্যাচার। সেইসময় যন্ত্রণাকাতর দামিনীর মুখ দিয়ে শুভ্রার আত্মা এ কথা বলে।

করুণ আর্তির কারণ : বক্তা দামিনীকে ভরসন্ধ্যাতে অশরীরী আত্মা ভর করে, ফলে সে উঠোনে আছড়ে পড়ে এবং হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে তার দাঁতে দাঁত লেগে যায়। প্রতিবেশীরা কলশি কলশি জল ঢেলে তার মূর্ছা ভাঙে। কিন্তু মূর্ছা ভাঙলে দেখা যায় সে অর্থহীন দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাচ্ছে, আপনমনে হাসছে ও কাঁদছে এবং যারা ধরে রাখছিল তাদের সে আঁচড়ে-কামড়ে পালাবার চেষ্টা করছে। তারপর সেখানে এসে হাজির হয় এলাকার নামকরা গুণিন কুঞ্জ। কুঞ্জ এসেই তার গুণপনা শুরু করে দেয়। প্রথমে সে সকলকে দাওয়া থেকে নামিয়ে দেয় এবং মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে জল ছেটাতে থাকে এবং দামিনীর এলোচুল শক্ত করে দাওয়ার খুঁটিতে বেঁধে ফেলে। কুঞ্জ এভাবে বেঁধে ফেলাতে তার নড়ার শক্তি থাকে না। এরপর সে মালসাতে আগুন করে শুকনো পাতা, শিকড় ইত্যাদি পোড়াতে থাকে যার উৎকট গন্ধে > চারিদিক ভরে যায়। দামিনী আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং কুঞ্জর দিকে নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে সময়ে কুঞ্জ একটা হলুদ পুড়িয়ে দামিনীর নাকে ধরে-তার শরীরে শিহরন বয়ে যায় এবং কুঞ্জর “কে তুই?” প্রশ্নের উত্তরে সে বলে “আমি শুভ্রা গো,… আমায় মেরো না।“ নিরন্তর অত্যাচারে ক্লান্ত দামিনী এমন উক্তি করেছিল।

(৯) “ধীরেন আর্তনাদ করে উঠল” -ধীরেনের আর্তনাদের কারণ কী ? এই আর্তনাদের মধ্য দিয়ে ধীরেনের কীরূপ মানসিকতা ফুটে উঠেছে। ২+৩=৫

উত্তর:

ধীরেনের আর্তনাদের কারণ: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অলৌকিকতার মোড়কে মানুষের অবচেতন মনের নানান পরিসর গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। মনোবিকারতত্ত্বের বৃহত্তর পরিসর এখানে স্বল্প আয়তনের মধ্যে ধরা দিয়েছে। এ গল্পে ধীরেনকে বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, সমাজসংস্কারী শিক্ষক হিসেবে প্রথম দিকে দেখা গেলেও তার বোন শুভ্রা খুন হওয়ার পর থেকেই তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। দামিনীর মুখ দিয়ে শুভ্রা খুনের কাল্পনিক কেলেঙ্কারি চাউর হতেই ধীরেন নিজেকে দোষী ভেবে ধীরে ধীরে মর্মাহত হতে থাকে এবং লোকসমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকে-কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। এরূপ মনোবিকারগ্রস্থ অবস্থায় ডোবার ধারে বাঁশঝাড়টার ছায়ায় মানুষের মতো একটা কিছু নড়াচড়া করতে দেখে ধীরেন আর্তনাদ করে ওঠে।

আর্তনাদের মধ্যে ফুটে ওঠা ধীরেনের মানসিকতা : এই আর্তনাদকারী অর্থাৎ ধীরেনকে গল্পের প্রথমদিকে যেভাবে দেখতে পাওয়া গেছে পরবর্তীতে কোনোভাবেই মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধীরেন ফিজিক্স অনার্স পড়া, স্কুলে ভূগোলের শিক্ষক, বই পড়ে সাধারণ রোগের বিনামূল্যে চিকিৎসা করত, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে সমিতি, লাইব্রেরি গঠনের মতো কাজ সে করে। কিন্তু কাহিনি এগিয়ে যাবার পথে লক্ষণীয় ছিল ধীরেনের কুসংস্কারাচ্ছন্নতার মোড়কে আবদ্ধ হতে থাকা। বোনের খুন হওয়ার পর গুণিনের গুণপনার গুণে যখন সেটা প্রকাশিত হয় যে, বলাই চক্রবর্তীর মতো লোকের হাতে তার বোনকে খুন হতে হয়েছে; তখনই তার মধ্যে একটা কাল্পনিক কেলেঙ্কারির অসম্মানবোধ জাগ্রত হয়ে উঠেছে এবং সেটা সে প্রায় মেনেও নিয়েছে। সে নিজেকে এতটা ছোটো ভাবতে শুরু করেছে যে, পরিচিত স্কুলের পরিবেশে সে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্কুলের সেক্রেটারি যখন তাকে ছুটিতে যেতে বলে তখন সে সামান্য প্রতিবাদটুকুও করতে পারে না। বিজ্ঞানমনস্ক ধীরেন সন্ধ্যার অন্ধকারে বোনের আত্মার সাথে যোগাযোগ করার জন্য ডোবার দিকে পা বাড়িয়ে অশরীরী আত্মার কবলে পড়ে। কাহিনির ঘটনাক্রম অনুসারে লক্ষ করা যায়-ধীরেন প্রতিবাদহীন দুর্বল চিত্তের একজন মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি।

(০)বাঁশটা সরিয়ে দাও”- বক্তা কোন বাঁশটাকে সরিয়ে দেওয়ার আর্তি জানিয়েছে ? এই আর্তির পিছনের কারণ আলোচনা করো। ২+৩=৫

উত্তর:

উদ্দিষ্ট বাঁশের পরিচয় : উদ্ধৃত উক্তিটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পের অন্যতম চরিত্র ধীরেনের, যে সম্পর্কে শুভ্রার দাদা। তিন দিন আগে পরে গ্রামে যে দুজনের মৃত্যু হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন শুভ্রা। খুন দুটিকে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার মাঝে শুভ্রার অশরীরী আত্মা যখন দামিনীর শরীরে ভর করে তখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শুভ্রার দাদা-বৌদিকে অনেকেই অশরীরী আত্মার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য নানান কাল্পনিক পরামর্শ দিতে থাকে। গ্রামের ক্ষেন্তি পিসি কাঁচা বাঁশের দু-দিক পুড়িয়ে অশরীরী আত্মাকে প্রতিহত করার কথা বলে। ধীরেনের স্ত্রী শান্তি বাড়ি ও ডোবার ঘাটের মাঝে সেই বাঁশ পেতে রেখেছিল। এখানে ওই পেতে রাখা বাঁশটির কথাই বলা হয়েছে।

বাঁশ সরিয়ে দেওয়ার আর্তির কারণ: খুন হওয়ার একুশ দিনের মাথায় নবীনের স্ত্রী দামিনীর ওপর যখন অশরীরী আত্মা ভর করে এবং কুঞ্জ গুণিন যখন দামিনীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেয় যে, সে শুভ্রা এবং বলাই খুড়ো তাকে খুন করেছে-তখন বোনের এই কাল্পনিক কেলেঙ্কারির জন্য যুক্তিবাদী ধীরেনও নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে। প্রতিদিনের জীবন থেকে সে যেন নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকে। মনের মধ্যে ক্ষোভ এবং বিষাদ এতটাই প্রভাব ফেলে যে, মাঝে মাঝে সে নিজেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে-নয়তো তার কেমন যেন একটা কষ্ট হত। বোন শুভ্রার আত্মাকে নিজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেবার জন্য ফেলে রাখা বাঁশ ডিঙিয়ে সে ডোবার মাঠের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে অদ্ভুত বিকৃত গলায় তার নিজের নাম ধরে ডাক শুনে স্ত্রী শান্তি এসে দেখে তার কাপড়ে ও গেঞ্জিতে কাদা ও রক্তমাখা এবং চিবুক থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।মাটিতে শোয়ানো বাঁশটুকু সে পার হতে পারছে না। তার মধ্যে তখন অশরীরী আত্মা ভর করেছে এবং তাকে নিয়েই সে বাড়িতে প্রবেশ করতে চায়; আর সেজন্যই সে তার পথের বাধা পোড়া বাঁশটিকে সরিয়ে নেওয়ার আর্তি জানিয়েছে।

(১) “আমি বলাই চক্রবর্তী। শুভ্রাকে আমি খুন করেছি।” বক্তা ধীরেনের এই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে তার জীবনের কোন্ সত্যটিকে লেখক তুলে ধরেছেন ? ৫

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মধ্যবিত্ত মননের কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকটিকে তুলে ধরা। দিন তিনেকের মধ্যে গ্রামে দু-দুটি খুন হয়ে যায় এবং সেই খুন দুটির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টায় যখন গ্রামবাসী মরিয়া, তখন সেভাবে গাঁয়ের কেউ মনে করতে পারছিল না যে শুভ্রাকে বলাই চক্রবর্তী কবে শুধু চোখের দেখা দেখেছিল। তাই সাময়িকভাবে সেই সংযোগ স্থাপিত না-হলেও একুশ দিন পর বলাইয়ের ভাইপো নবীনের স্ত্রী দামিনীকে যখন অশরীরী আত্মা ভর করে তখন তা আবার মাথাচড়া দিয়ে ওঠে। কুঞ্জ গুণিন যখন দামিনীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেয়- “আমি শুভ্রা…। বলাই খুড়ো আমায় খুন করেছে।“-তখন দামিনীর এই কথা লোকমুখে চাউর হতে থাকে। ধীরেনের মতো বিজ্ঞানপড়া যুক্তিবাদী মানুষও মধ্যবিত্তের কুসংস্কারাচ্ছন্ন গণ্ডি অতিক্রম করতে না-পেরে বোনের এই মৃত্যুর জন্য কোথাও যেন নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে। ক্রমাগত একই ভাবনা ভাবতে ভাবতে ধীরেন যেন একটু একটু করে কুসংস্কারের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হতে থাকে। এক ভর সন্ধেতে অত্যন্ত সন্তর্পণে ধীরেন স্ত্রী শান্তির উঠোনে রাখা দু-মুখ পোড়া বাঁশ ডিঙিয়ে ডোবার মাঠের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে সে কাদামাখা ও রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে আসে এবং নিজের নাম ধরে ডাকতে থাকে। এসব দেখে শান্তি আর্তনাদ করে ওঠে। দেখা যায় ধীরেন সামান্য বাঁশটুকু ডিঙিয়েও আসতে পারছে না। এরপরে আসে কুঞ্জ, তার সম্মোহন বিদ্যার কাছে হার মেনে ধীরেনের স্বীকারোক্তি- “আমি বলাই চক্রবর্তী। শুভ্রাকে আমি খুন করেছি।” এক্ষেত্রে ধীরেন যে তার বোনের খুনের ব্যাপারে সামান্যতমও দায়ী নয়, অবচেতন মনের সে কথাটাই ধীরেন যেন প্রমাণ করতে চেয়েছে। এক্ষেত্রে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধীরেন যতই যুক্তিবাদী হোক না কেন সে একজন মধ্যবিত্ত মননেরই প্রতিনিধি।

() ‘হলুদ পোড়া’ গল্পের নবীন চরিত্রটি আলোচনা করো। ৫

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম ছোটোগল্প ‘হলুদ পোড়া’। এই গল্পে গ্রামীণ অজ্ঞতা ও অন্ধবিশ্বাসের ওপর ভর করে ভৌতিক আবহে মানুষের মধ্যে যে বিকারগ্রস্ততা দেখা দেয়, তা লেখক সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এই গল্পের অন্যতম চরিত্র নবীন; যে, সম্পর্কে খুন হয়ে যাওয়া বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো। গল্পের প্রেক্ষাপটে তার চরিত্রের কিছু পরিচয় তুলে ধরা হল-

(ক) সম্পত্তির প্রতি আকর্ষণ : বলাই চক্রবর্তীর নৃশংস হত্যার পর কাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিল সে, তাই তার দখল নেওয়ার জন্য শিক্ষিত নবীন চল্লিশ টাকা মাহিনার চাকরি ছেড়ে শহর থেকে গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করে।

(খ) ছলনার আশ্রয়: নবীনের চরিত্রের মধ্যে একটা ছলনাকে আশ্রয়ের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা লক্ষ করা গিয়েছে। তার মধ্যে যতটা-না দুঃখ ও প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা ছিল, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল উপস্থিত গ্রামবাসীদের সামনে মিথ্যা কান্নার অভিনয় করা। তাই সে কখনও কোঁচার কাপড়ের খুঁটে চশমার কাচ মুছতে মুছতে চোখও মুছতে থাকে।

(গ) আত্মসম্মানবোধ : নবীনের মধ্যে যথেষ্ট আত্মসম্মানবোধ লক্ষ করা গেছে। সে শুধুমাত্র কাকার বিষয়সম্পত্তির প্রতি যে আগ্রহী ছিল তা নয়, বরং লোকলজ্জার ভয়ে কাকার খুনীদের সন্ধান দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করে।

(ঘ) গ্রাম্য কুসংস্কারের আবর্তে আবর্তিত: নবীন শিক্ষিত, কর্মসূত্রে শহরে থাকলেও গ্রামীণ কুসংস্কারের সাগরে হাবুডুবু খেয়েছে। তার স্ত্রী দামিনীকে যখন অশরীরী আত্মা ভর করেছিল তখন সে ডাক্তার অপেক্ষা ওঝার ওপর বেশি আস্থা প্রকাশ করেছিল। যদিও সে শেষমেশ কৈলাশ ডাক্তারকে ডাকতে পাঠিয়েছিল।

এ ছাড়া নবীন চরিত্রটি যে বৈষয়িক; তা বোঝা যায় যখন সে ওঝা কত টাকা নেবে জিজ্ঞেস করে। ছোটোগল্পের ছোটো পরিসরে এইভাবে নবীন চরিত্রটি লেখকের হাতে পড়ে সমকালীন সময়ের সমাজে হয়ে উঠেছিল ভীষণ উজ্জ্বল একটি চরিত্র।

(৩) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্প অবলম্বনে ধীরেন চরিত্রটি আলোচনা করো। ৫

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠগল্পের অন্তর্গত একটি অন্যতম ছোটোগল্প হল ‘হলুদ পোড়া’। গ্রামীণ ভৌতিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তারই এক অনুপম মনস্তাত্ত্বিক গল্প ‘হলুদ পোড়া’। এই গল্পের অন্যতম চরিত্র হল ধীরেন। আলোচ্য গল্পের প্রেক্ষাপটে তার চরিত্রের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। সেগুলি হল-

(ক) যুক্তিবাদের প্রতীক: ধীরেন যেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তমসাবৃত সমাজে হঠাৎ আলোর ঝলকানি। গল্প যতই এগিয়েছে ধীরেনের এই মনোভাব স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। ফিজিক্স অনার্স পাস করে সে গাঁয়ের স্কুলে ভূগোল পড়ায়। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার সুবাদে সে বিভিন্ন বইপত্র পড়ে যেটুকু চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছিল তা দিয়ে গণ্ডগ্রামের হতদরিদ্র মানুষদের পদ্ধতি মেনে ছোটোখাটো চিকিৎসা করত। তার যুক্তিবাদী মনোভাবের কারণেই সে তার বন্ধুস্থানীয় নবীনকে তার স্ত্রীর অসুস্থতার সময় ওঝার বদলে ডাক্তার ডাকার পরামর্শ দেয়। শুধু তাই নয়, রোগের উপসর্গ বুঝতে পেরেও শুধুমাত্র পাস করা ডাক্তার নয় বলে সে নবীনের স্ত্রীর চিকিৎসাও করেনি।

(খ) সমাজসংস্কারক: ধীরেন শিক্ষিত ও সচেতন। সে বুঝেছিল তাদের যে সমাজ; তার সংস্কার প্রয়োজন। জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর জন্য সে সাতচল্লিশখানা বই নিয়ে তার বাড়িতে লাইব্রেরি খোলে। এর পাশাপাশি এলাকার কিছু ছেলেকে নিয়ে সমিতি গঠন করে। উভয় ক্ষেত্রেই লক্ষ্য-সমাজের উন্নতি। ধীরেনের এই চেষ্টা কিন্তু সফল হয়নি। সময় যত গড়িয়েছে ধীরেনের এই চেষ্টা ফিকে হতে শুরু করে। তিনশো বই নিয়ে লাইব্রেরি এবং তরুণ সমিতিও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।

(গ) কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ : ধীরেন শুভ্রার দাদা, তাই গর্ভবতী শুভ্রা যখন সন্তান প্রসবের জন্য তাদের বাড়ি এসেছিল, তখন সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে। পুকুরঘাটে নামতে বোনের যাতে অসুবিধা না হয়, সে তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে ঘাট বেঁধেছিল।

(ঘ) জনসেবা ও আত্মসম্মানবোধ : ধীরেন তার সমাজকে ভালো করেই বুঝত। তাই সে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলো অসুস্থ হলে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সে সাধারণ রোগজ্বালার চিকিৎসা করত এবং চারআনা আটআনা ফি নিয়ে ওষুধপথ্যও দিত।

এসব সত্ত্বেও ধীরেন অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামীণ সংস্কারের আবর্তে আবর্তিত হয়েছে। তার প্রমাণ-অধিক সন্তানের জন্ম দেওয়া ও তার ওপর অশরীরী আত্মা ভর করেছে সে-কথা ভেবে কুসংস্কারের চোরাবালিতে তার আটকে পড়া।

আরও পড়ুন

হারুন সালেমের মাসি গল্পের প্রশ্ন উত্তর

প্রার্থনা কবিতার প্রশ্ন উত্তর

তিমির হননের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর

কেন এল না কবিতার প্রশ্ন উত্তর

নানা রঙের দিন নাটকের বড় প্রশ্ন উত্তর

ডাকঘর প্রশ্ন উত্তর

বাঙালির চিত্রকলার ইতিহাস – সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রশ্ন উত্তর

বাঙালির চলচ্চিত্রের ইতিহাস – সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রশ্ন উত্তর

YouTube – Samim Sir

Leave a Comment