নানা রঙের দিন নাটকের বড় প্রশ্ন উত্তর। দ্বাদশ শ্রেণী । চতুর্থ সেমিস্টার । Class 12 Nana Ronger Din Natok Long Question Answer Semester 4
নানা রঙের দিন নাটকের বড় প্রশ্ন উত্তর
Mark – 5
(১) নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রবিশ্লেষণ করো। [সংসদ নমুনা প্রশ্ন] ৫
[অথবা],
‘নানা রঙের দিন’ নাটকে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের যে নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের ছবি ফুটে উঠেছে আলোচনা করো। ৫
উত্তর:
প্রধান চরিত্র- রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়:
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটির প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে নেশাগ্রস্ত, নিঃসঙ্গ রজনীকান্তের চরিত্রের নানান দিক তাঁর স্মৃতিচারণার সূত্র ধরে একে একে উন্মোচিত হয়।
নাটকের প্রতি দায়বদ্ধ: রাঢ় বাংলার ভদ্র ব্রাহ্মণ বংশজাত রজনীকান্ত অল্পবয়সেই পুলিশের ইনস্পেক্টর পদে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু নাটকের প্রতি অদম্য ভালোবাসার টানে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। ক্রমে প্রতিভাবান অভিনেতা রজনীকান্ত শিল্পসৃষ্টির তাগিদে যৌবন-আদর্শ- শক্তি-সম্ভ্রম-প্রেম ও নারী এ সব কিছুকেই উৎসর্গ করেন।
নিঃসঙ্গ ও হতাশ : রজনীকান্ত উপলব্ধি করেন দর্শকের মনোরঞ্জনে অভ্যস্ত অভিনেতা আসলে এক ভাঁড় মাত্র, যার কোনো সামাজিক সম্মান নেই; কেবল রয়েছে সীমাহীন একাকিত্ব আর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিভাকে হারানোর দুঃসহ গ্লানি ও হতাশা।
সংশয় ও দ্বন্দ্বে দীর্ণ: জীবনের শেষপ্রান্তে ধীরে ধীরে মৃত্যুর শিয়রে এসে উপস্থিত হওয়ার নৈরাশ্য রজনীকান্তকে আরও অস্থির ও বিচলিত করে তোলে। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে তিনি ‘রিজিয়া’-র বক্তিয়ার কিংবা ‘সাজাহান’-এর ঔরঙ্গজীব বা শেকসপিয়রের ‘ওথেলো’-র মধ্য দিয়ে বার্ধক্য, ব্যাধি, একাকিত্ব ৪ এবং মৃত্যুভয়কে জয় করতে চান; আবার পরমুহূর্তেই স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে জীবনের বিদায়ধ্বনি শুনতে পান।
এভাবেই আক্ষেপ-ভালোবাসা-প্রতিভা ও নৈরাশ্যের দ্বন্দুময় টানাপোড়েনে এক নিঃসঙ্গ শিল্পীর অন্তরের একাকিত্বের অনুভূতির ভাষ্যকে প্রকাশ করেন অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
(২) “অভিনেতা মানে একটা চাকর-একটা জোকার, একটা ক্লাউন। লোকেরা সারাদিন খেটেখুটে এলে তাদের আনন্দ দেওয়াই হল নাটকওয়ালাদের কর্তব্য।”- বক্তার কথার তাৎপর্য আলোচনা করো। [সংসদ নমুনা প্রশ্ন] ৫
[অথবা],
“দেয়ালে অঙ্গারের গভীর কালো অক্ষরে লেখা, আমার জীবনের পঁয়তাল্লিশটা বছর”– ‘নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য আলোচনা করো। ৫
উত্তর:
প্রসঙ্গ: ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এক বৃদ্ধ প্রতিভাবান অভিনেতার জীবননাট্যকে উন্মোচন করেছেন। এ নাটকের প্রধান চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি একদিন অভিনয় শেষে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে ফাঁকা মঞ্চে দাঁড়িয়ে একাকিত্বে-হতাশায় তিনি প্রম্পটার কালীনাথ সেনের কাছে নিজের বর্ণময় অতীতের স্মৃতিচারণ করতে শুরু করেন।
তাৎপর্য: রাঢ় বাংলার এক ভদ্র ব্রাহ্মণ বংশে রজনীকান্ত জন্মেছিলেন। কিন্তু নাটকের প্রতি অদম্য ভালোবাসায় রজনীকান্ত পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন। নাটককে অবলম্বন করেই যশ-প্রতিপত্তি ও খাতিরে পূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর জীবন। এসময় একটি মেয়ে তাঁর প্রেমে পড়ে। বিয়ের স্বপ্ন দেখেন রজনীকান্ত, কিন্তু বিয়ের আগে থিয়েটার ছাড়ার প্রস্তাব মেনে নিতে পারেন না। সেদিন তিনি উপলব্ধি করেন অভিনেতার কদর শুধু মঞ্চে। অভিনেতা আসলে একজন ভাঁড়, যার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি বা সম্মান নেই। এরপর থেকে এলোমেলো হয়ে ওঠে রজনীকান্তের অভিনয় জীবন। তিনি আবোলতাবোল সব পার্ট করতে থাকেন। ক্রমশ ব্যক্তিগত জীবনে একাকিত্ব ও হতাশায় তিনি ডুবে যেতে থাকেন। এই আঘাত-যন্ত্রণা ও নিঃসঙ্গতাকেই তিনি প্রেক্ষাগৃহের দেয়ালে দেয়ালে কালো অঙ্গারে ফুটে উঠতে দেখেছেন।
(৩) “জীবনে ভোর নেই, সকাল নেই, দুপুর নেই, সন্ধেও ফুরিয়েছে-এখন শুধু মাঝরাত্তিরের অপেক্ষা”-এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বক্তার যে মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে তা আলোচনা করো। ৫
উত্তর:
প্রসঙ্গ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জীবনের প্রান্তে এসে একদিন দিলদারের চরিত্রে অভিনয় শেষে মদ্যপান করে গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙার পর অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় রজনীকান্ত যেন দুর্বিষহ বাস্তবের মুখোমুখি হন।
বক্তার এমন মনোভাবের কারণ: রজনীবাবু টের পান এভাবে আটষট্টি বছর অতিক্রম করে মৃত্যুর শিয়রে এসে পৌঁছেছেন। এখন তাঁর একমাত্র সম্বল সোনালি অতীত। এখন তিনি একজন ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। তাঁকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে অভিনয়ের সেইসব বর্ণময় মুহূর্তগুলি। যখন তাঁর আশ্চর্য প্রতিভায় চরিত্রগুলি নতুন রঙে নতুন চেহারায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। অথচ আজ থিয়েটাবে. র দেয়ালে কালো কালো অক্ষরে জীবনের শেষ কথাগুলো তিনি ফুটে উঠতে দেখেন। এ সময়ে তাঁরই সমবয়সিরা হেঁটে-বেড়িয়ে ভগবানের নাম করে পরম নিশ্চিন্তে জীবন কাটান আর বৃদ্ধ নেশাগ্রস্ত রজনীকান্ত নৈরাশ্যে-যন্ত্রণায় মধ্যরাত্রে আবোলতাবোল বকে চলেন। এই অস্থির-আক্ষেপ আসলে শিল্পী রজনীকান্তের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের হাহাকার। তাঁর প্রতিভা থাকলেও বয়স পেরিয়ে গেছে। এক ‘বুড়ো রজনী চাটুজ্জে’ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ানোয়; আবেগে হতাশায় রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন।
(৪) “আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রিনরুমে ঘুমোই চাটুজ্জেমশাই-কেউ জানে না’– বক্তা গ্রিনরুমে ঘুমান কেন ? ৫
উত্তর: আলোচ্য অংশটির বক্তা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের প্রম্পটার কালীনাথ সেন। নাটক শেষ হলে প্রতিদিন তিনি গ্রিনরুমকে ঘুমোনোর জায়গা হিসেবে ব্যবহার করেন, যদিও সে-কথা মালিক জানে না।
গ্রিনরুমে ঘুমোনোর কারণ: নাটক সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও ঘুম থেকে উঠে পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা অন্ধকার মঞ্চে যখন একাকী রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় অস্থির, ভীত, বেসামাল এবং তিনি উইংস দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলে ময়লা পাজামা ও কালো চাদর গায়ে এলোমেলো চুলে আর-এক বৃদ্ধ এসে ঢোকেন। তিনি প্রম্পটার কালীনাথ সেন। প্রথমে বৃদ্ধ রজনীবাবু কালীনাথকে চিনতে পারেনি। পরে তার পরিচয় জানতে পারলে এত রাতে তিনি কী করছেন জানতে চাইলে বৃদ্ধ কালীনাথ সেন জানান তার শোয়ার জায়গা না-থাকায় তাকে গ্রিনরুমে ঘুমোতে হয়। তখন এই মানুষটির চালচুলোহীন হতদরিদ্র অবস্থাটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। নাটককে ভালোবেসে নিজের ব্যক্তিজীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি কালীনাথ সেন। তাই তিনি রজনীবাবুকে বলেছেন গ্রিনরুমে ঘুমানোর কথাটা যেন মালিকের কানে না-যায়, তাহলে তিনি বেঘোরে মারা পড়বেন এবং শোয়ার জায়গাটুকু চলে যাবে। অর্থাৎ প্রশ্নোদ্ভূত উক্তির মধ্যে তৎকালীন সময়ে নাটকের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জীবনের দারিদ্র্য, অসহায়তা ও বঞ্চনার অন্ধকার দিকটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
(৫) “একদিন একটা মেয়ে থিয়েটার দেখে প্রেমে পড়ল আমার?” – বক্তা মেয়েটির রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা লেখো। প্রেমের পরিণতি কী হয়েছিল ? ৩+২=৫
[অথবা],
“মরে যাব তবু ভুলব না,”- যে রূপে মুগ্ধ হয়ে বক্তা এমন মন্তব্য করেছেন সেই রূপের বর্ণনা দাও। ভুলতে না পারার পরিণতি কী হয়েছিল ? ৩+২=৫
উত্তর:
মেয়েটির রূপের বর্ণনা: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে মেয়েটি উদ্ধৃতাংশের বক্তা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমে পড়েছিল। রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় কালীনাথ সেনকে তাঁর অতীতের কথা বলতে গিয়ে তাঁর প্রেমের কথা বলেছেন। রজনীবাবুর মতে তখন তিনি সবে নাটকে নেমেছেন তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে একটি মেয়ে তার প্রেমে পড়ে। রজনীবাবুর বর্ণনা অনুসারে সে বেশ বড়োলোকের মেয়ে, বেশ সুন্দর দেখতে-লম্বা, ফরসা, সুন্দর ছিপছিপে গড়ন। মেয়েটি ছিল উঠতি বয়সের-মনটা খুবই সুন্দর। তার টানাটানা কালো চোখ দেখে মনে হত কোনো অচেনা দিনের আলো। তার অদ্ভুত হাসি আর ঢেউখেলানো রাশি রাশি কালো চুলে ছিল আশ্চর্য এক শক্তি। মেয়েটির রূপের অপূর্ব স্নিগ্ধতা দেখে রজনীর এদিন মনে হয়েছিল সে যেন ভোরের আলোর চেয়েও সুন্দর। তার সেই রূপের ছটা রজনীকান্তকে মোহিত করে দিয়েছিল।
পরিণতি : রজনীকান্ত বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে একদিন মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেয়েটি বিয়ের আগে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। সেদিন রজনীকান্ত উপলব্ধি করেন ধনী ঘরের সুন্দরী মেয়ে জীবনভর নাটকের অভিনেতার সঙ্গে প্রেম করলেও বিয়ে করে সংসার করার কথা ভাবতেও পারে না। অর্থাৎ তাঁদের প্রেম বিবাহে রূপান্তরিত হয় না। তাই সারাজীবন নিঃসঙ্গ অবিবাহিত থেকে যান রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
(৬) “সে কী আশ্চর্য মেয়ে কেমন করে বোঝাব তোমাকে ?” -মেয়েটি সম্পর্কে বক্তার অনুভূতির পরিচয় দিয়ে ঘটনার পরিণতি কী হয়েছিল লেখো। ৫
[অথবা],
“ও কী বলল জানো?”– প্রসঙ্গ নির্দেশ করে ‘সে’ কী বলেছিল আলোচনা করো।
উত্তর:
মেয়েটি সম্পর্কে রজনীকান্তের অনুভূতি: ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় বিবর্ণ বর্তমানের হতাশা-যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে ক্রমে সোনালি অতীতের দিনগুলিতে ফিরে যান। তখন তিনি এক প্রতিভাবান তরুণ অভিনেতা। যশ-প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ তাঁর জীবন। এসময় আলমগিরের চরিত্রে অভিনয় দেখে একটি মেয়ে প্রেমে পড়ে তাঁর। ধনী ঘরের এই মেয়েটি সুন্দর দেখতে ছিল আর মেয়েটির সহজসরল মনে কোনো জটিলতা ছিল না। রজনীকান্ত তাঁর হৃদয়ের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্তের আগুন। তাঁর টানাটানা কালো চোখে যেন প্রতিফলিত হত কোনো অচেনা দিনের আলো। মেয়েটির দীর্ঘ কালো চুলে লুকিয়ে ছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের আশ্চর্য শক্তি। ভোরের আলোর চেয়েও সুন্দর এই মেয়েটি প্রেমের অপ্রতিহত শক্তিতে রজনীকান্তকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর একরকম অদ্ভুত করে চেয়ে থাকার সম্মোহন রজনীকান্তকে আজও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
ঘটনার পরিণতি: অভিনয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত রজনীকান্ত বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে একদিন মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেয়েটি বিয়ের আগে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। সেদিন রজনীকান্ত উপলব্ধি করেছিলেন ধনী ঘরের সুন্দরী মেয়ে জীবনভর নাটকের অভিনেতার সঙ্গে প্রেম করলেও বিয়ে করে সংসার করার কথা ভাবতেও পারে না।
(৭) “সেই রাত্রেই জীবনে প্রথম মোক্ষম বুঝলুম যে, যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প’-তারা সব গাধা”-বক্তা কখন এবং কেন এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন নিজের ভাষায় আলোচনা করো। ৫
[অথবা],
“এই পবিত্রতার নামাবলিটা সেদিন হঠাৎই ফাঁস হয়ে গেল আমার সামনে” বক্তার এমন মন্তব্যের কারণ আলোচনা করো।
উত্তর:
কখন: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। মধ্যরাতে দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহে দাঁড়িয়ে নেশাগ্রস্ত রজনীকান্ত নিজের যৌবনের সোনালি অতীতে ফিরে যান। একে একে তাঁর মনে পড়তে থাকে পরিবার-চাকরি-অভিনয় প্রতিভা-খ্যাতি ও প্রতিপত্তির কথা। এ প্রসঙ্গেই স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর একমাত্র প্রেমের ঘটনার কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
বক্তার এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর কারণ: একটি মেয়ে রজনীকান্তের অভিনয় দেখে তাঁর প্রেমে পড়েছিল। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা ক্রমে প্রেমে পরিণত হলে রজনীকান্ত মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেয়েটি বিয়ের আগে তাঁর কাছে থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার শর্ত আরোপ করে। নাটক-অন্ত – প্রাণ রজনীকান্ত প্রেমিকার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের সেই রাতেই উপলব্ধি করেন অভিনেতা আসলে একটা ভাঁড়। সে সার্কাসের ক্লাউন বা জোকারের মতো – দর্শকের মনোরঞ্জন করে মাত্র। এই মেডেল-করতালি-প্রশংসা-সার্টিফিকেট শুধু মঞ্চে অভিনয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব জীবনে অভিনেতার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি বা প্রতিষ্ঠা নেই। নাট্যাভিনয়ের পবিত্রতার নামাবলির পর্দাটা সেদিনই রজনীকান্তের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। নিজের খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও দর্পের কাচের স্বর্গটা চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ে। এখানে আক্ষেপ ও যন্ত্রণার এই আত্মোপলব্ধিকে ফুটিয়ে তুলতেই তিনি প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন।
(৮) “এই তো জীবনের সত্য কালীনাথ’-জীবনের সত্য কী ? বক্তা কীভাবে এই সত্যে উপনীত হলেন ? ২+৩=৫
[অথবা],
“এই তো জীবনের সত্য কালীনাথ”-বক্তা জীবনের কোন সত্যের কথা বলতে চেয়েছেন তা আলোচনা করো। ৫
উত্তর: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্ক নাটকে মঞ্চাভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় আটষট্টি বছর বয়সে অভিনয় শেষের এক রাত্রিতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রম্পটার কালীনাথ সেনের সঙ্গে কথোপকথনকালে এমন উপলব্ধি করেছেন।
জীবনের সত্যের স্বরূপ: অভিনয় জীবনের পঁয়তাল্লিশ বছর অতিক্রম করে তিনি অনুভব করেছেন তাঁর জীবন ক্রমশ এগিয়ে চলেছে সমাপ্তির পথে। যৌবনে তাঁর শরীরে ছিল বল, চেহারায় ছিল জেল্লা, মনে ছিল অফুরন্ত সাহস। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়েছে। থিয়েটারের প্রতি গভীর ভালোবাসায় একসময় তিনি ত্যাগ করেছিলেন পরিবার, স্বজন, প্রেম, সুনিশ্চিত চাকরি। শিল্পকে আঁকড়ে ধরে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনুভব করলেন, বয়সের ছাপ ধীরে ধীরে তাঁর অভিনয়ে পড়ছে। দিন দিন তাঁর খ্যাতি, প্রতিপত্তি কমে যাচ্ছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁর উপলব্ধি, “অভিনেতা মানে একটা চাকর-একটা জোকার, একটা ক্লাউন।“ অভিনেতার সামাজিক কোনো মানমর্যাদা নেই। নাটকওয়ালাদের তাঁর মনে হয়েছে, “একটা ভাঁড় কি মোসায়েবের যা কাজ তাই।”
সত্যের উপলব্ধি: জীবনের সায়াহ্নে উপনীত হয়ে রজনীকান্ত উপলব্ধি করেছেন যে, শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা ও গভীর ভালোবাসা, অভিনয়ে নিষ্ঠাবান, চরিত্রকে হৃদয়ঙ্গম করে তার গভীরে প্রবেশ করতে পারলে ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট-বেদনা লঘু হয়ে যায়। তিনি এও বুঝেছেন, তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের শোকানল, অনুভূত চিতার আঁচ, সমাগত মৃত্যুর নিশ্বাস শিল্পীর প্রতিভার কাছে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র হয়ে যায়; প্রতিভাই শেষ কথা বলে। দক্ষ অভিনেতা রজনীকান্তের মধ্যে এই প্রতিভার বিচ্ছুরণ আছে। তিনি মনে করেন, প্রতিভাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বয়সকে তুচ্ছ করে দিতে পারে। জীবনের চিরন্তনী শক্তি হল এই প্রতিভা। রজনীকান্ত মনে করেন “প্রতিভা যার আছে, বয়েসে তার কি আসে যায়!” অভিনেতা রজনীকান্তের কাছে এটাই জীবনের চরম সত্য। এই জীবনসত্য তাঁর জীবনীশক্তি। জীবনের নানা অপমান, লাঞ্ছনা, বার্ধক্য-জরা এমনকি মৃত্যুভয়কেও তিনি উপেক্ষা করতে পারেন এই জীবনসত্য দিয়েই।
(৯) “শিল্পকে যে-মানুষ ভালোবেসেছে তার বার্ধক্য নেই কালীনাথ,”–‘নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখো। ৫
[অথবা],
“শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে-তার বার্ধক্য নেই কালীনাথ, একাকিত্ব নেই” বলতে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় কী বুঝিয়েছেন আলোচনা করো ।
উত্তর:
প্রসঙ্গ: ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের মুখ্য চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। আটষট্টি বছর বয়সে পৌঁছে তিনি অভিনেতা জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হন। তাঁর অভিনয় জীবনের খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও উচ্চাশার সোনালি অতীত আজ তাঁর কাছে স্মৃতি মাত্র। ফলে হতাশ ও আহত রজনীকান্তের সুরাসক্তি বাড়ে। প্রম্পটার কালীনাথের কাছে তিনি শিল্পীহৃদয়ের একাকিত্ব-যন্ত্রণা-অপমান এবং অসম্মানের এই ইতিহাসকেই তুলে ধরেন। এসব কথা বলতে গিয়েই বারবার আঁকড়ে ধরতে চান হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনগুলিকে।
তাৎপর্য: নির্ভীক ‘বক্তিয়ার’, নিঃসঙ্গ-রক্তাক্ত ‘ঔরঙ্গজীব’ কিংবা পিয়ারাবানুকে বলা সুজার শেষ সংলাপের প্রেমমগ্ন আবেগে রজনীকান্ত খুঁজে পান নিজের দুঃখময় জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি নাটককে ভালোবেসেই তো চাকরি ছেড়েছেন, বিসর্জন দিয়েছেন প্রেম; যৌবন, আদর্শ, শক্তি, সম্ভ্রম ও নারী-এসব কিছুকে নাটকের কাছেই নির্দ্বিধায় উৎসর্গ করেছেন। আজ তিনি উপলব্ধি করেছেন, ‘আমার প্রতিভা এখনও মরেনি’। অর্থাৎ এক শিল্পীর কাছে শিল্পসৃষ্টির তাগিদ ছাড়া বাকি সব তুচ্ছ। জীবনের চরমতম সত্য হল শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি চূড়ান্ত আত্মনিবেদন। যে-মানুষ শিল্পকে ভালোবেসেছে; সে রোগ, বার্ধক্য, একাকিত্ব ও মৃত্যুভয়কে হেলায় অবজ্ঞা করে চলে। প্রশ্নোদ্ভূত অংশে শিল্পী রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় সে কথাই বলতে চেয়েছেন।
(১০) “এই তো জীবনের নিয়ম!’– জীবনের কোন নিয়মের কথা বলা হয়েছে ? এই উক্তির মধ্য দিয়ে বক্তার কোন্ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় ? ২+৩=৫
উত্তর:
জীবনের কঠোর নিয়ম: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নানা রঙের দিন’ নাটক থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশে জীবনের শাশ্বত নিয়মের কথা বলা হয়েছে। আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত জীবনের শেষ লগ্নে অনেক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ও হতাশায় দার্শনিকের মতো জীবনসত্যের অমোঘ নিয়মের কথা ব্যক্ত কালীনাথের কাছে করেছেন। তাঁর কথায়, পৃথিবীতে জন্ম-জরা-মৃত্যু স্বাভাবিক জীবকূলের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, শিল্পী তার ব্যতিক্রম নয়। জগতের এই চিরন্তন নিয়ম সকলকেই মানতে হয়। রজনীকান্তের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
বক্তার মানসিকতা : দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনে রজনীকান্ত বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তিনি অনুভব করেছেন, যৌবনকালে অভিনয়ের যে দক্ষতা তাঁর ছিল বয়সের ভারে তা নষ্ট হয়েছে। চরিত্রকে বুঝে চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা আগের মতো তাঁর আর নেই। কিন্তু আটষট্টি বছর বয়সেও তিনি মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী। অভিনয়কে ভালোবেসে রজনী জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। অভিনয় তাঁর জীবনের একটা প্যাশান, অভিনয় তাঁর মনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। তাই তিনি মনে করেন, “শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে-তার বার্ধক্য নেই,…একাকিত্ব নেই, রোগ নেই”; শিল্পই তাঁর প্রাণ, তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। প্রকৃত শিল্পপ্রতিভার মৃত্যু হয় না, শিল্পকে যে মানুষ প্রাণপণে ভালোবাসতে পেরেছে, শিল্পই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে রজনীকান্ত এই জীবনসত্যের সম্মুখীন হন যে, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা শিল্পীকে অমরত্ব দান করে। শিল্পীর বহুমুখী প্রতিভা তাকে চিরঞ্জীবী করে রাখতে পারে।
(১১) “আমিও তো মানুষ কালীনাথ।“– কোন প্রসঙ্গে বক্তা এমন কথা বলেছেন ? বক্তা কেন এমন মন্তব্য করেছেন ? ২+৩=৫
[অথবা],
“হায়রে প্রতিভা। কোথায় গেল বলো তো ?”– প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ‘নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে বক্তার এমন উপলব্ধির কারণ বিশ্লেষণ করো। ২+৩=৫
উত্তর:
প্রসঙ্গ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের মুখ্য চরিত্র আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের এমন উপলব্ধি। একদিন মদ্যপ অবস্থায় মধ্যরাত্রে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে থিয়েটারের কালো দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পান। তিনি টের পান এই সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনে যৌবন, আদর্শ, শক্তি, সম্ভ্রম, প্রেম ও নারী-একে একে সব পার করে এসেছেন। যে অনায়াস সাবলীলতায় তিনি চরিত্রগুলিকে নতুন রঙে ভরিয়ে তুলতে পারতেন, আজ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই দক্ষতাও তিনি হারাতে বসেছেন। এভাবে একে একে সব হারাতে বসা এক মানুষের জীবনের দুঃসহ একাকিত্ব আর তার সঙ্গেই নাটক-অন্তপ্রাণ এক শিল্পীর সামাজিক অবস্থান, উভয়ের তীব্র টানাপোড়েন দেখে প্রম্পটার কালীনাথ বিস্মিত হন। এর প্রত্যুত্তরেই রজনীকান্ত প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেন।
উপলব্ধির কারণ বিশ্লেষণ: জীবনের প্রান্তবেলায় পৌঁছে অভিনেতা রজনী চাটুজ্জে তাঁর দ্বৈত-জীবনের কথা ভেবে গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ব্যক্তিজীবনে মঞ্চের বাইরে তিনি সম্পূর্ণ একা, সমাজ-বিচ্ছিন্ন এবং পরিত্যক্ত। কারণ তাঁর কোনো সঙ্গী-সাথী-পরিবার কিছুই নেই আর দর্শকের কাছে এক অভিনেতার যাবতীয় খাতির মঞ্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে মরার সময় দু-ফোঁটা জল দেওয়ারও কেউ নেই তাঁর। অন্যদিকে বয়সের কারণে চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্য আর গলার কাজ ফুটিয়ে তোলার সূক্ষ্মতাও নষ্ট হয়ে আসছে। তাই তাঁর মনে হয়েছে, থিয়েটারের দেয়ালে কারও অদৃশ্য হাত অঙ্গারের কালো কালো জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে দিয়ে গেছে অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ। এখন তিনি নায়কের চরিত্রের বদলে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু আর কয়েকবছর পর তাঁকে সেখানেও মানাবে না। শুধু ব্যক্তিগত আবেগ ও নাটকের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবনের পাত্রকে পূর্ণ করা যায় না। এভাবেই শিল্পীর জীবন থেকে প্রতিভা-সম্মান-খ্যাতি ও জৌলুষ একে একে বিদায় নেয়।
(১২) ‘নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে প্রম্পটার কালীনাথ সেনের চরিত্রবিশ্লেষণ করো। ৫
[অথবা],
‘নানা রঙের নিন’ নাটক অবলম্বনে কালীনাথ সেনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তর:
পার্শ্বচরিত্র-কালীনাথ সেন: ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের পার্শ্বচরিত্র কালীনাথ সেন আজীবন পেশাদারি থিয়েটারে প্রম্পটারের কাজ করেছেন। তাঁর ভূমিকায় যেমন মঞ্চের আলো পড়ে না, তেমনই জীবনও বঞ্চনার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকে।
সহায়সম্বলহীন: কালীনাথের ময়লা পাজামা ও কালো চাদরে অভাব এবং দারিদ্রের চিহ্ন স্পষ্ট। এরপর তিনি যখন বলেন শোয়ার জায়গা না-থাকায় তাঁকে গ্রিনরুমে ঘুমোতে হয়, তখন এই মানুষটির চালচুলোহীন হতদরিদ্র অবস্থাটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়।
সহানুভূতিশীল: রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-হতাশা-একা কিত্ব কালীনাথকেও আলোড়িত করে। বৃদ্ধ রজনী চাটুজ্জেকে শান্ত করতে কালীনাথ পুরোনো দিনের কথা না-ভাবার পরামর্শ দেন।
নাট্যপ্রেমী : প্রম্পটার কালীনাথেরও যে নাটকের প্রতি দরদ কিছু কম নয়, তা বোঝা যায় যখন তিনি সাবলীলতার সঙ্গে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মহম্মদের সংলাপ বলতে শুরু করেন। তাই প্রতিভাবান বৃদ্ধ রজনীকান্তের অসামান্য একক অভিনয় তাঁর চোখে জল আনে। শেষে তিনি যখন বলে ওঠেন, ‘আমি বলছি রজনী চাটুজ্জে মরবে না-কিছুতেই না-‘ তখন যেন বৃদ্ধ শিল্পীর প্রতি এক নীরব নাট্যপ্রেমীর শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতিবাক্য ধ্বনিত হয়।
এভাবেই কালীনাথ সেন মানবিকতায়-সাহচর্যে ও দুঃখযন্ত্রণার অংশীদারিত্বে একটি সার্থক রক্তমাংসের চরিত্র হয়ে ওঠে।
(১৩) ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের সূচনায় মঞ্চসজ্জার যে বর্ণনা আছে, তা নিজের ভাষায় লেখো। নাটকটির নামকরণ কতখানি সার্থক-তা আলোচনা করো। ২+৩=৫
উত্তর:
মঞ্চসজ্জার বর্ণনা: ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের সূচনায় মঞ্চসজ্জার যে বর্ণনা আছে, তা এইরূপ-পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় একটি পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা রঙ্গমঞ্চ। প্রায় অন্ধকার সেই মঞ্চে রয়েছে রাত্রে অভিনীত ‘সাজাহান’ নাটকের দৃশ্যপট, আর বেশ কিছু জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছড়ানো। মঞ্চের মাঝে আছে একটি ওলটানো টুল। দর্শক-আসনও একেবারে ফাঁকা।
পরবর্তী উত্তরের জন্য নং প্রশ্নের উত্তরটি দেখো ।
(১৪) ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটির নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো। ৫
উত্তর: সাহিত্যের যে-কোনো সংরূপেই নামকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই নামকরণ সাধারণত তিন প্রকারের হয়- চরিত্রকেন্দ্রিক, ঘটনাকেন্দ্রিক ও ব্যঞ্জনাধর্মী। এখন আলোচ্য অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের নামকরণ কোন্ প্রকারভুক্ত এবং তা কতদূর সার্থক ও সংগত।
এক বৃদ্ধ অভিনেতার আত্ম-উন্মোচনের ভাষ্য হল পাঠ্য একাঙ্ক নাটক ‘নানা রঙের দিন’। এই নাটকের নায়ক বৃদ্ধ নট রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি একদিন অভিনয় শেষে অতিরিক্ত মদ্যপান করে বেসামাল হয়ে প্রেক্ষাগৃহের গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে গভীর রাতে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে একলা নিজেকে আবিষ্কার করেন দিলদারের পোশাকে। সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনে এই প্রথম মধ্যরাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ রজনীকান্তের মনে হয়; তিনি যেন মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। জনমানবহীন দুপুরের জ্বলন্ত { মাঠের বাতাসের মতো মনে হয় নিজেকে। সঙ্গীসাথি-আত্মীয়পরিজনহীন, সম্পূর্ণ একা। অথচ একদিন তাঁর জীবনে খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও খাতির সবই ছিল। থিয়েটারকে ভালোবেসে চাকরি ছেড়েছেন। নাটকের প্রতি অবিচ্ছেদ্য টানে প্রেমিকাকে বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু জীবনের আটষট্টিটা বছর পার করে আজ মনে হয়, যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প’, তারা মিথ্যা কথা বলে। আসলে অভিনেতা একটা চাকর বা ক্লাউন ছাড়া আর কিছুই নয়। সে ভাঁড়ের মতো দর্শকের মনোরঞ্জন করে মাত্র। এই একাকিত্ব, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারার অক্ষমতা, পরিত্যক্ত ও স্বীকৃতিহীন অভিনেতার জীবন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। অথচ একদিন ‘সাজাহান’ নাটকের ঔরঙ্গজীব কিংবা ‘রিজিয়ার’ বক্তিয়ার চরিত্রকে কেমন নতুন রঙে ভরিয়ে তুলেছিলেন তিনি। এ জন্যেই তিনি উপলব্ধি করেন শিল্পীর বার্ধক্য, একাকিত্ব কিংবা মৃত্যুভয় নেই। কারণ প্রতিভার মৃত্যু হয় না। অথচ শুধু অভিনয়-প্রতিভা দিয়ে তো আর বুড়ো রজনী চাটুজ্জের বর্তমান জীবনের শূন্য পাত্রকে পূর্ণ করা যায় না। এভাবেই আশা, আক্ষেপ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, বিশ্বাস ও নৈরাশ্যের টানাপোড়েনে এক অভিনেতার জীবনের বর্ণময় অতীতের সঙ্গে আজকের বর্ণহীনতার বহুমাত্রিক সমন্বয়ে, ‘নানা রঙের দিন’-এর ব্যঞ্জনাবাহী নামকরণ হয়ে ওঠে সার্থক ও সংগত।
(১৫) “আমাদের দিন ফুরিয়েছে।”-কে, কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন? বক্তার এই উপলব্ধির কারণ ব্যাখ্যা করো। ২+৩=৫
উত্তর: বক্তা এবং প্রসঙ্গ আলোচ্য উক্তিটি ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রম্পটার কালীনাথ সেনকে বলেছেন। থিয়েটারের মঞ্চে অতীতের সোনালি দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন বৃদ্ধ অভিনেতা দিলদারের পোশাক পরিহিত অবস্থায় রজনীকান্ত। আর সেইসব শুনতে শুনতে প্রম্পটার কালীনাথ যখন কেঁদে ওঠে তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জলভরা চোখে তিনি আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।
দ্বিতীয় অংশের উত্তরের জন্য ১৬ নং প্রশ্নের উত্তরটি দ্রষ্টব্য।
(১৬) ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্ক নাটক হিসেবে কতখানি সার্থক আলোচনা করো। ৫
উত্তর: একাঙ্ক নাটকের আঙ্গিক অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ একটি সার্থক একাঙ্ক নাটক। নাটকের একাঙ্ক, পঞ্চাঙ্ক ইত্যাদি বিভাজন হয়ে থাকে। সাধারণত স্বল্প পরিসরে সীমায়িত নাট্যঘটনা একটিমাত্র অঙ্কের মধ্যে বিন্যস্ত হলে তাকে একাঙ্ক নাটক বলা হয়। একাঙ্ক নাটকের কখনও দৃশ্য বিভাজন থাকে, আবার কখনও দৃশ্য বিভাজন ছাড়াই সমগ্র নাটকটি অভিনীত হয়। যেমন, ‘নানা রঙের দিন’-এ কোনো দৃশ্য বিভাজন নেই। এখানে একটি রাতের মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ঘটনার সূত্রপাত-দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি-নাটকীয় উৎকণ্ঠা এবং নাটকীয় পরিণাম; এক মাত্রাহীন ব্যঞ্জনা লাভ করেছে।
একাঙ্ক নাটক হিসেবে সার্থকতা পাঠ্য ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের মুখ্য চরিত্র পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের এক সময়কার খ্যাতিমান অভিনেতা বৃদ্ধ রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি মধ্যরাতে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চের কালো দেয়ালের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পান। তিনি টের পান এই সুদীর্ঘ অভিনেতা জীবনে যৌবন, আদর্শ, শক্তি, সম্ভ্রম, প্রেম ও নারী-একে একে সব পার করে এসেছেন। যে অনায়াসে সাবলীলতায় চরিত্রগুলিকে নতুন রঙে ভরিয়ে তুলতে পারতেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই দক্ষতাও তিনি হারিয়েছেন। চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্য আর গলার কাজ তাঁর নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তাঁর মনে হয়েছে, থিয়েটারের দেয়ালে কারও অদৃশ্য হাত অঙ্গারের কালো কালো জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে দিয়ে গেছে অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ। এখন তিনি নায়কের চরিত্রের বদলে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। আর কয়েক বছর পর তাঁকে সেখানেও মানাবে না। কিন্তু যৌবনের দিনগুলির স্মৃতিচারণ তাঁকে উদ্বেল করে তোলে। তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে ‘রিজিয়া’-র বক্তিয়ার কিংবা ‘সাজাহান’-এর ঔরঙ্গজীবের সংলাপ। তিনি ঘোষণা করেন প্রতিভার অবিনাশী ঐশ্বর্যের কথা। তাঁর অসামান্য অভিনয়ে প্রম্পটার কালীনাথের চোখে জল আনে। তবে বৃদ্ধ রজনী চাটুজ্জের পরমুহূর্তেই মনে হয় শুধু ব্যক্তিগত আবেগ ও নাটকের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবনের পাত্রকে পূর্ণ করা যায় না। শিল্পীর জীবন থেকে প্রতিভা-সম্মান-খ্যাতি ও জৌলুষ সব একে একে – বিদায় নেয়। এভাবেই এক অভিনেতার শিল্পী হৃদয়ের আর্তি ও আর্তনাদ-চরিত্রচিত্রণে, একমুখী ঘটনার সংহত তীব্রতায় এবং তীক্ষ্ণ মর্মস্পর্শী সংলাপে ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটিকে একটি সার্থক ও প্রাণবন্ত একাঙ্ক নাটকে পরিণত করে তুলেছে।
(১৭) “… প্রাক্তন অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ!”- বক্তার উল্লেখসহ এই অপমৃত্যু কীভাবে ঘটে বলে বক্তা মনে করেন ? ৫
উত্তর: বক্তা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটক থেকে সংকলিত প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটির বক্তা হলেন নাটকের মুখ্য চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
প্রতিভার অপমৃত্যুর ঘটনা: রজনী চাটুজ্জে আটষট্টি বছর বয়সে এসে পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনের স্মৃতিচারণায় মগ্ন হয়েছেন। কমবয়সে তিনি যখন অভিনয় জীবনে আসেন তখন একটি মেয়ে তাঁর অভিনয় দেখে প্রেমে পড়ে। সেই মেয়েটি তাঁকে বিয়েও করতে চায়, কিন্তু শর্ত হিসেবে মেয়েটি জানায় রজনী যদি অভিনয় ছেড়ে দেয়, তবেই সে বিয়ে করবে। সেদিন তিনি বুঝতে পারেন, যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প’, তারা সব গাধা। তারপর থেকে সেই মেয়েটির আর কোনো খোঁজ পাননি; তবে তাঁরও আর কিছু ভালো লাগত না। ভবিষ্যৎ চিন্তা, ভালো নাটক বাছাই করা বা ভালো চরিত্র ফুটিয়ে তোলা-এসব একে একে লাটে উঠল। বয়স বাড়ল, গলার কাজ নষ্ট হয়ে গেল, একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেল। সেদিন রজনী দেখতে পেলেন-কোনো অদৃশ্য হাত থিয়েটারের দেয়ালে অঙ্গারের কালো কালো অক্ষরে লিখে দিয়ে গেল, রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ।
(১৮) “প্রতিভা যার আছে, বয়েসে তার কী আসে যায়”-প্রসঙ্গসহ বক্তার এমন মন্তব্যের কারণ বিশ্লেষণ করো। ৫
উত্তর:
প্রসঙ্গ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় শূন্য রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে অতীতের স্মৃতিচারণায় ডুব দেন। মধ্যরাতে প্রেক্ষাগৃহের দেয়ালে কালো কালো জ্বলন্ত অক্ষরে যেন কারো অদৃশ্য হাতে লিখিত হতে দেখেন তাঁর প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ।
বক্তার প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যের কারণ: বৃদ্ধ রজনী চাটুজ্জেকে নিজেরই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় হতাশা ও যন্ত্রণায় শিউরে ওঠেন। তাঁর মনে পড়ে যায়, যৌবনের দিনগুলির কথা, যখন প্রতিভার আশ্চর্য স্পর্শে নাটকের চরিত্রগুলি নতুন রঙে জীবন্ত হয়ে উঠত। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কখনও তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে ‘রিজিয়া’ নাটকের বক্তিয়ারের কথা, আবার কখনও ‘সাজাহান’ নাটকের ঔরঙ্গজীবের সংলাপ। এসময় ভ্রাতৃহত্যার রক্তে রক্তাক্ত ঔরঙ্গজীবের দুঃস্বপ্ন-গ্লানি ও অন্তর্দ্বন্দের অংশটি অভিনয় করার পরে তৃপ্তিতে তিনি হাততালি দিয়ে জোরে হেসে ওঠেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারেন প্রতিভার অবিনাশী ঐশ্বর্যের কথা। তিনি টের পান, একে একে আটষট্টিটা বছর অতিক্রান্ত হলেও, প্রতিভা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাঁর রক্তের মধ্যে মিশে থাকা প্রতিভার গুণেই তিনি বার্ধক্যকেও পর্যুদস্ত করতে পেরেছেন। একেই এক শিল্পীর জীবনের চিরকালীন সত্য বলে মনে করে, রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন।
(১৯) আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে”- ‘পাগল’-এর পরিচয় দাও। তার ‘পাল্লায় পড়া’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? ২+৩=৫
উত্তর:
পাগল-এর পরিচয়: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটক থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশে ‘পাগল’ বলতে থিয়েটারের কর্মী রামব্রিজের কথা বলা হয়েছে। রজনীকান্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। হতাশার যন্ত্রণায় রজনী যখন মদ খেয়ে গ্রিনরুমে পড়ে থাকেন, রামব্রিজ-ই তাঁকে ঘুম থেকে তুলে ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি পাঠান। তার এই পরোপকারিতার জন্য রজনী তাকে তিন টাকা বকশিশ দিলে সেই টাকায় মদ কিনে দুজনে খেয়েছে। আজ শূন্য প্রেক্ষাগৃহে রামব্রিজকে ডেকে সাড়া না-পাওয়ায় তাকে ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করেছেন রজনী।
‘পাল্লায় পড়া’ : ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে ফাঁকা মঞ্চে দিলদারের পোশাকে এসে উপস্থিত হতে দেখা যায়। তিনি অভিনয় শেষে অতিরিক্ত মদ্যপান করে গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মধ্যরাতে নির্জন প্রেক্ষাগৃহে অসংলগ্ন অবস্থায় রজনীকান্তের (২০) “মুখের ভেতরটা যেন অডিটোরিয়াম-ইন্টারভ্যালে সব দর্শকরা হাঁটাহাঁটি লাগিয়ে দিয়েছে…”-মন্তব্যটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এর সার্থকতা বিচার করো। ৩+২=৫
উত্তর:
প্রসঙ্গ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে দেখা যায় যে, মধ্যরাতে এক পেশাদারি থিয়েটারের শূন্য প্রেক্ষাগৃহের প্রায় অন্ধকার ফাঁকা মঞ্চে আটষট্টি বছরের প্রবীণ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জ্বলন্ত। মোমবাতি হাতে নিয়ে প্রবেশ করেছেন। তাঁর পরনে ছিল সদ্য সমাপ্ত হওয়া নাটকের দিলদার চরিত্রে অভিনয় করার পোশাক। অভিনয়ের পর মদ্যপ অবস্থায় তিনি গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পরেছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন নাটকের অন্যান্য চরিত্রাভিনেতা সবাই চলে গিয়েছেন। নিস্তব্ধ রাতের শূন্য প্রেক্ষাগৃহে তিনি কেবল একা। মদের নেশা কাটলে শুকনো গলায় তৃয়ার্ত রজনীকান্তের মনে হয়েছে অতিরিক্ত মদ্যপানে তাঁর বুকের ভিতরটা যেন কাঁপছে আর শারীরিক কষ্ট হচ্ছে। তাঁর মুখের ভিতরটা যেন একটা অডিটোরিয়াম যেখানে বিরতিতে সব দর্শকরা চলাচল করছে।
মন্তব্যের সার্থকতা : ‘অডিটোরিয়াম’ বলতে সাধারণত মঞ্চসহ প্রেক্ষাগৃহকে বোঝানো হয়, যেখানে মঞ্চের সামনে দর্শকদের বসার জন্য থাকে সারিবদ্ধভাবে আসন, যা ধাপে ধাপে ক্রমশ উপরের দিকে চলে যায়। ইনটারভ্যালে দর্শকরা নিজের আসন ছেড়ে নানা প্রয়োজনে প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে চলাফেরা করে। নেশাগ্রস্ত রজনীকান্তের অবচেতন মনে হয়তো থিয়েটারের নানা দৃশ্যপট কাজ করছিল। তাই মুখগহ্বর শুকিয়ে এলে তৃষ্ণার্ত জিহ্বার যে কষ্ট তিনি অনুভব করেছেন, তার সঙ্গে তুলনা করেছেন অডিটোরিয়ামে নাট্যাভিনয়ের সময় দর্শকদের অবিন্যস্ত চলাচলের দৃশ্যকে।
(২১) “এখন শুধু মাঝরাত্তিরের অপেক্ষা-এখানেই গল্প শেষ।” -বক্তা কীভাবে জীবনের এই চরম সত্যে উপনীত হলেন তা বুঝিয়ে দাও। ৫
উত্তর: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্ক নাটকটিতে এক শিল্পীর আত্মোপলব্ধির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।
মানবজীবনের অমোঘ নিয়ম: পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা মঞ্চে দাঁড়িয়ে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনের আত্মনিরীক্ষণ করেছেন। নিস্তদ্ধ রাতে দিলদারের পোশাক পরিহিত রজনীকান্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় টুলের ওপর বসে আত্মকথনে মগ্ন। নিজের জীবনের উত্থান-পতনের স্বরূপ উপলব্ধি করতে গিয়ে তিনি অতীতের নানা কথা স্মরণ করেছেন। একসময় তিনি অভিনয়ের জন্য ত্যাগ করেছিলেন প্রেমিকাকে। শিল্পকে ভালোবেসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করেছেন থিয়েটারে। থিয়েটারই ছিল তাঁর আত্মার সঙ্গী, পরম ভালোবাসা। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে থিয়েটারের জন্য তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্ট উপেক্ষা করে নিরলসভাবে মানুষকে আনন্দ দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর দুঃখ-যন্ত্রণা-ব্যাথার শরিক কেউ হয়নি কখনও। তিনি বুঝেছেন এক-পা এক-পা করে তিনি ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন জীবনের অন্তিম লগ্নে। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এখন মাঝরাত্তিরের জন্য অপেক্ষমাণ।
প্রকৃতি ও মানবজীবন প্রকৃতির নিয়মেই পৃথিবীতে দিনরাত্রি সংঘটিত হয়। দিনের সূচনা হয় ভোরের স্নিগ্ধতায়, এরপর ক্রমশ ভোর থেকে সকাল, সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুরের পর বিকেল, বিকেলের পর সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যার পর শেষ সময় রাত্রি। একইভাবে মানুষের জীবনও নানা পর্যায় অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। বাল্য, শৈশব ও কৈশোরের পরে আসে যৌবনকাল। মানবজীবনের সেরা সময়-ব্যাপ্তিকাল। এরপর যৌবনের পড়ন্তবেলায় আসে বার্ধক্য। তারপর একটু একটু করে কেবল অপেক্ষা করা মধ্যরাতের জন্য। মানবজীবনের যথার্থ এই স্বরূপ উপলব্ধি করে রজনীকান্ত এমন উক্তি করেছেন।
আরও পড়ুন –
বাঙালির চিত্রকলার ইতিহাস – সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রশ্ন উত্তর
বাঙালির চলচ্চিত্রের ইতিহাস – সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রশ্ন উত্তর
YouTube – Samim Sir