বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা সাজেশন ও উত্তর // একাদশ শ্রেণী বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার // Class 11 2nd Semester Rochona Suggestion & Answer

বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা সাজেশন ও উত্তর // একাদশ শ্রেণী বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার // Class 11 2nd Semester Rochona Suggestion & Answer

বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা

চলভাষ ছাড়া চলমান জীবন অচল

উত্তর – মতের পক্ষে

ভূমিকা: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ‘আবিষ্কারের অভিযান’ প্রবন্ধে লিখেছেন- “বিজ্ঞান ছাড়া মানবমুক্তির আর কোনো পথ নেই।” কারণ, বিজ্ঞানের যুগে আমরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছি বিজ্ঞাননির্ভর। এই বিজ্ঞাননির্ভরতার অতি পরিচিত নাম চলভাষ বা মোবাইল ফোন। দিনের শুরু থেকে রাতের ঘুম পর্যন্ত আমরা চলভাষ বা মুঠোফোনের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং সেসব কারণে আমি মনে করি চলভাষ ছাড়া চলমান জীবন প্রায় অচল, তার যুক্তি হল-

জীবনের ছায়াসঙ্গী : বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্মার্টফোন বা চলভাষ অন্যতম জীবনসঙ্গীতে পরিণত। রাতের বেলায় মাথার পাশে, সকালবেলায় চায়ের টেবিলে, দুপুরবেলায় খাবারের সারিতে, কর্মক্ষেত্রে, চলমান জীবনের সর্বত্র, স্কুলকলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদের জীবন আজ হাতের মুঠোয় স্মার্টফোনের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত বস্তু হিসেবে চলভাষ আর আমাদের কাছে বোঝা নয় বরং তাকে বহন করার মধ্যে অনুভূত হয় এক আনন্দ। অনেক সময় একটি নয় একাধিক চলভাষ বা স্মার্টফোন আমাদের কাজের অন্যতম ব্যবহার্য সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে, অথচ কোথাও বিরক্তি নেই, বরং স্মার্টফোন ভুলে যাওয়া মানেই, জীবনটা যেন ষোলো আনা খাপছাড়া।

যোগাযোগের অপরিহার্য মাধ্যম: মোবাইল ফোন বা চলভাষ আজ যোগাযোগের অন্যতম অপরিহার্য মাধ্যম। একটা সময় চিঠিপত্র, টেলিবার্তা, ফ্যাক্স, টেলিগ্রাম ইত্যাদি মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ তৈরি করত কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। টেলিগ্রাম ছিল অতি সংক্ষিপ্ত বার্তা। এর ফলে মানুষ অপেক্ষায় ছিল এমন এক মাধ্যম বা যন্ত্রের, যাতে মুহূর্তের মধ্যে একজন মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর অপর প্রান্তে থাকা মানুষের দ্রুত সংযোগ গড়ে ওঠে। শুধু কথা নয়, ভিডিয়ো কলিং এই সম্পর্ককে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

যুগোপযোগী হওয়ার মাধ্যম: একটা সময় যারা নিরক্ষর তারা যেমন চিঠি লিখতে পারতেন না, এখন সেই নিরক্ষর ব্যক্তিরাও মোবাইল ফোন বা চলভাষের দৌলতে ক্রমশ আধুনিক হয়ে উঠছে। লেখাপড়া-জানা মানুষ মোবাইল ফোনের সহায়তায় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার গতি খুঁজে পাচ্ছে। বরং স্মার্টফোন বা চলভাষ ব্যবহার করতে না পারাটা মানুষের কাছে সংকোচের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার হাতে কত দামি ফোন, তাই নিয়েও রয়েছে অন্যরকম আনন্দ-বিষাদ। সুস্থসবল, শিক্ষিত অশিক্ষিত, প্রতিবন্ধী থেকে অন্ধ-সকলের কাছেই মোবাইল ফোন যুগের সঙ্গে উপযোগী হয়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে পরিণত।

ইনটারনেট ব্যবস্থার সুফল প্রাপ্তি: বর্তমান সময়ে ল্যাপটপ, ডেস্কটপের বিকল্প হয়ে উঠেছে মুঠোফোন বা চলভাষ। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইনটারনেট পরিসেবা কাজে লাগানো যাচ্ছে। যখন যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই তার উপযোগিতা লক্ষণীয়। শিক্ষা থেকে ব্যাবসাবাণিজ্য, ব্যাংকিং পরিষেবা, যানবাহন কিংবা রেল পরিসেবা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রই আজ তালুবন্দি শুধুমাত্র একটি চলভাষ বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।

উপার্জনের মাধ্যম: বর্তমান সময়ে ফেসবুক রিল, শর্ট ভিডিয়ো ইত্যাদি থেকে যাবতীয় বিনোদনের মাধ্যম ব্যবহার করে একশ্রেণির মানুষ বাড়িতে বসে উপার্জনের পথ খুঁজে পেয়েছে। একদিকে উপস্থাপক, অন্যদিকে উপভোক্তা। শুধু তা-ই নয়, স্মার্টফোন বা মোবাইল ফোনের সহায়তায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লুকোনো প্রতিভা জনসমাজের কাছে উপস্থাপিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে গণমাধ্যমে।

উপসংহার: সুতরাং এসব কারণে আমি মনে করি, মোবাইল ফোন বা চলভাষ ব্যতীত চলমান জীবন প্রায় অচল।

মতের বিপক্ষে –

ভূমিকা: যাযাবর ‘দৃষ্টিপাত’-এ লিখেছেন- “আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েস।” সুতরাং সাম্প্রতিক সময়ে চলভাষ বা মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের অন্যতম ছায়াসঙ্গীতে পরিণত হলেও যেসব কারণে আমি মনে করি চলভাষ ছাড়া চলমান জীবন অচল নয় তা হল-

ভোগসর্বস্বতা: আমরা সচেতনে অচেতনে ক্রমশ মোবাইল ফোন বা চলভাষের শিকার হয়ে উঠেছি। জগতকে তালুবন্দি করতে গিয়ে আমরা বন্দি হয়েছি মোবাইল ফোনে। অনেক সময়েই ভোগসর্বস্বতা, উশৃঙ্খলতা এবং মূল্যবোধহীনতার শিকার হতে হয় এই চলভাষের জন্য। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের পক্ষে মোবাইল ফোন দিন দিন ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। তাদের জীবনকে করে তুলছে আরও বেশি উচ্ছৃঙ্খল এবং লাগাম-ছাড়া। শুধু কি কিশোর-কিশোরী? পরিণত বয়সের মানুষেরাও মোবাইল ফোনের জন্য মূল্যবোধহীন এক মানবকঙ্কালে পরিণত হচ্ছে।

ছাত্রজীবনের পক্ষে ক্ষতিকর: মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের কারণে ছাত্রজীবন ও তাদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ সংকটের দিকে দ্রুত ধাবমান হচ্ছে। চলভাষে বুঁদ হয়ে অধিক রাত্রি পর্যন্ত জাগরণে মানসিক অবসাদ, অসহিষ্ণুতা, অধ্যয়ন বিমুখ মনোভাব ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। এমনকি স্মার্টফোনের জন্যই আজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনৈতিক, অশালীন ক্রিয়াকর্মের : বৃত্ত পরিসর লাভ করছে। মাদকতা, কম বয়সেই অকালপক্কতা,বড়োদের প্রতি অশ্রদ্ধা-এসবের জন্য দায়ী অন্যতম ডিভাইস হল এই মোবাইল ফোন।

অনৈতিক কাজের সহায়ক: আজকাল ফেসবুক, ইউটিউব, শর্ট ভিডিয়ো থেকে রিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে শালীনতাবোধ বা সম্ভ্রম তলানিতে ঠেকেছে। কমে যাচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ। ঘরে বসে উপার্জনের জন্য নানা রকমের বিনোদন সংক্রান্ত ভিডিয়ো, ছবি, বিভিন্ন অ্যাপ বা ভিডিয়ো কলিং-এর মাধ্যমে প্রতারণার বৃত্ত বড়ো হচ্ছে। ভিডিয়ো কল শেষ হতেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। বাড়ছে সাইবার ক্রাইম-সহ ব্যাংক জালিয়াতি। এমনকি নিষিদ্ধ কাজ-কারবার করার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে চলভাষ।

পরোক্ষ ঘাতকের ভূমিকায়: চলভাষ বা মোবাইল ফোন এমনই একটি ডিভাইস, যা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমের সীমা অতিক্রম করে যায়। খোলা প্রাঙ্গণে প্রাণ খুলে গল্প করার লোকজন নেই। বন্ধুত্বের হিল্লোল থেমে গেছে মুঠোফোনে। তার পরিবর্তে এক-একজন এক-একটি চলভাষ নিয়ে বিচ্ছিন্ন বৃত্তে আসক্ত হচ্ছে। নেই সুখ-দুঃখের কথাবার্তা, সমানুভূতির প্রলেপ। কুটুম্বিতা বা আতিথেয়তার জায়গা নিয়েছে ফোন কলিং বা ভিডিয়ো কলিং ব্যবস্থা। একই পরিবারে এক-এক জনের হাতে পৃথক পৃথক ব্রান্ডের স্মার্টফোন বা চলভাষ থাকার ফলে ফিকে হচ্ছে পারিবারিক সম্পর্কের মধুরতা। অন্যদিকে মোবাইল ফোনের সাহায্যে নিত্যনতুন গড়ে উঠছে অনৈতিক সম্পর্ক, পরিবারে ধরছে ভাঙন।

শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ : আমরা জানি, চলভাষে সংযোগ তৈরির সময় ইলেকেট্রাম্যাগনেটিক রেডিয়েশন সৃষ্টির ফলে মানবশরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কে ক্যানসার, হৃদরোগ, বধিরতা, মানসিক অবসাদ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ কারণে মানুষ কমবেশি খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে এবং মানসিক বিকারে ভুগছে। ভিড় বাড়ছে স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে। বলাবাহুল্য, সর্বত্র ইনটারনেট পরিসেবা সহজলভ্য হওয়ায় শিশু থেকে পরিণত মানুষেরাও শারীরিক ও মানসিক রোগে কমবেশি আক্রান্ত হচ্ছে। যত্রতত্র সেলফি বা নিজস্বী তোলার প্রবণতা মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনছে।

উপসংহার: সুতরাং সার্বিক আলোচনায় চলভাষ বা মোবাইল ফোনের ভালো দিকের আড়ালে রয়েছে অজস্র ক্ষতিকর দিকও। তাই যে মাধ্যম মানুষের সংযম কেড়ে নিয়ে তাকে যান্ত্রিক করে তোলে, সেই চলভাষ বা মোবাইল ফোন ছাড়া জীবন মোটেও অচল নয়।

েসবুকআশীর্বাদ

উত্তর – মতের পক্ষে –

ভূমিকা: Mark Zuckerberg মনে করেন- “Facebook is all about information and helping people share it.” সুতরাং বলা যায়, জনপ্রিয় গণমাধ্যম ফেসবুক আমাদের কাছে যে কারণে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে, তা হল-

বন্ধুত্বের সোপান: ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। যে-কোনো মানুষ অন্যের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পারে। ফেসবুকের মাধ্যমে হাজার হাজার বন্ধুর কাছে নিজেকে অতি দ্রুত উপস্থাপন করা যায়। মজার কথা, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকলে পছন্দের মানুষকে Friend request পাঠানো যায়। Request গ্রহণ করলে তখন বন্ধুত্বের পর্ব শুরু হয়। আবার ইচ্ছে করলে যে-কোনো মানুষকে Unfriend করাও সম্ভব। অতি সাধারণ মানুষ ফেসবুকে জগতের খ্যাতিমানদের সঙ্গে অনায়াসে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারেন। তাই আমার কাছে ফেসবুক আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

একের মধ্যে অনেক: ফেসবুক এমনই একটি গণমাধ্যম যেখানে বিভিন্ন রকমের তথ্য, তত্ত্ব, সংবাদ, অতি দ্রুত হাতের মুঠো এসে যায়, আবার পাঠানোও যায়। যাবতীয় প্রচার বা ভাববিনিময়, পারিবারিক ছবি ও ভ্রমণের ভিডিয়ো, কিংবা ভালোলাগা সব কিছুই ফেসবুকে পোস্ট করা যায়।জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা থেকে সম্মান অর্জন, কিংবা বিদেশে উপার্জনের আনন্দ পর্যন্ত ফেসবুকে শেয়ার করা হয়। এমনকি নতুন থেকে পুরোনো বইপত্র, বাড়ির আসবাবসামগ্রী ইত্যাদি কেনাবেচার মাধ্যম ফেসবুক। নিজের যেটুকু প্রতিভা আছে তা প্রচারের মঞ্চ হল ফেসবুক। সুতরাং এমন একটি গণমাধ্যম মানুষের কাছে পরমপ্রাপ্তি বলেই গণ্য হয়।

নিঃসঙ্গের বন্ধু: ফেসবুকের আশীর্বাদে কোনো মানুষই এখন আর একা নয়। ঘরে বসে মুঠোফোনের মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, সুখ-দুঃখ কিংবা আনন্দের বিষয় Share করে আত্মতৃপ্তি জাগে। এমনকি অবসর জীবনে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মোবাইল ফোনে গড়ে তুলছেন নিজস্ব পরিমণ্ডল। প্রাণ খুলে দুটো কথা বলা বা কথা শোনার মতো লোকের অভাব যখন প্রকট, তখন ফেসবুকই নিঃসঙ্গের বন্ধু। তাই ফেসবুকের উপযোগিতা বর্তমান মানুষের কাছে আশীর্বাদের বার্তা নিয়ে এসেছে।

উপার্জনের মাধ্যম: যত দিন যাচ্ছে ফেসবুক আরও উন্নত হচ্ছে। আপলোড হচ্ছে প্রতিনিয়ত শর্ট ভিডিও, রিল যা অসংখ্য বেকার যুবক-যুবতির উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। কেউ কেউ live-এ এসে অনুগামীদের নিয়ে সংযোগ তৈরি করছে আর জনপ্রিয়তার নিরিখে রোজগারের অঙ্কও জমা পড়ছে তার অ্যাকাউন্টে। শারীরিক পরিশ্রম নয় বরং উপস্থাপনা ঠিকঠাক হলে, কিংবা একটু স্মার্ট হলে Viewer-এর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনও বাড়ছে। অন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনার চেয়ে নিজের কৃতিত্বে ফেসবুক থেকে উপার্জন অনেক বেশি সুবিধাজনক, তাই তাদের কাছে ফেসবুক আশীর্বাদও বটে!

বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ: ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো অপরিচিতজন বন্ধু হয়ে যায়। যুদ্ধ সংঘটিত হলে যেমন তার জন্য প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ফেসবুকে, তেমনি বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও গড়ে উঠছে। ফেসবুকে বন্ধুত্ব গড়তে লাগে না পাসপোর্ট বা ভিসা। কখনও ফেসবুকের দৌলতে প্রেম থেকে বৈবাহিক সম্পর্কও তৈরি হচ্ছে। ফেসবুক না থাকলে নিশ্চয়ই এমন সম্পর্ক গড়ে-ওঠা কখনোই সম্ভব ছিল না।

উপসংহার: পরিশেষে আবার মার্ক জুকারবার্গের ভাষায় বলতে হয়- “Facebook was not originally created to be a company. It was built to accomplish a social mission, to make the world more open and connected.” কাজেই এইসব কারণে আমি মনে করি, বর্তমান প্রজন্মের কাছে ফেসবুক একটি আশীর্বাদ।

মতের বিপক্ষে –

ভূমিকা: বর্তমান সময়ে নানা গণমাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফেসবুক মারাত্মক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কাজেই কারও মনে হতে পারে, ফেসবুক এ যুগের আশীর্বাদ, কিন্তু আমি মনে করি ফেসবুক আমাদের জীবনে এক ধরনের অভিশাপ। তার সপক্ষে যুক্তি হল-

সময়ের অপচয়: আমাদের কাছে প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মহার্ঘ্য। ফেসবুকের জন্যই সময়ে যথাযথভাবে কর্তব্য করতে না পারার জন্য অনুতাপ জাগে। ফেসবুকে হয়তো অবসর সময় কেটে যায়, কিন্তু বিপরীতে এটি এমন এক আসক্তির মাধ্যম, যা ব্যবহারে থাকে না সময়ের কোনো হিসেবনিকেশ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করার কারিগর এই ফেসবুক। অনুতাপের পরেও ঘন ঘন Update নিতে গিয়ে মানুষ ভুল করে আবার সময় নষ্টের বৃত্তে ঢুকে পড়ে। তাই যে গণমাধ্যম মানুষের এত ক্ষতি করতে পারে, তা আশীর্বাদ তো নয়ই বরং এক অভিশাপ।

ফেসবুক বিভ্রান্তির মাধ্যম: নিজের পরিচয় গোপন রেখে, Display picture-এ অন্যের ছবি দিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপনের মাধ্যমে চলে প্রতারণা। এ নিয়ে ফেসবুকে নেই কোনো বিধিনিষেধ, এমনকি ব্যক্তিগত তথ্যও নিরাপদ নয়। অনেকে ফেসবুকে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকে অপরিপক্ক মানুষদের ভিডিয়ো কলিং-এর মাধ্যমে প্রতারিত করে, মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের ফাঁদ পাতে। ভুল তথ্যের ওপর গড়ে-ওঠা বিতর্ক অনেক সময়ই মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। এর ফলে ফেসবুক থেকে আজকাল নানা ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।

ফেসবুক পারিবারিক অশান্তির কারণ : ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে উপার্জনের জন্য আজকাল একশ্রেণির নরনারী আসরে নেমেছেন। শর্ট ভিডিয়ো থেকে রিল, কখনও-বা live-এ মতো বিষয় জোরপূর্বক সামাজিক ও পারিবারিক করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক সম্ভ্রম। অশ্লীলতা প্রদর্শন, অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে পারিবারিক অশান্তি চরম আকার নিচ্ছে। কিন্তু এখন পরিবারের সবই যে-যার মতো রিল বানাতে ব্যস্ত। গভীর রাত পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। পরিবারের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। ফেসবুক না থাকলে এই ধরনের অভিশপ্ত পর্ব সংঘটিত হত না।

ফেসবুক অ-কাজের মাধ্যম: আমি মনে করি, ফেসবুক কার্যত এক অকেজো গণমাধ্যম। অনেক সময়েই সংকটকালে যতটা সহানুভূতির বন্যা হয়ে যায়, ততটা সহায়তা মেলে না। দুঃস্থ রোগীর জন্য আর্থিক সাহায্য প্রার্থনা করলে, প্রতারণার গন্ধে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনেক সময়ই, বিপদের সময় ফেসবুকের বন্ধুর সাড়া পাওয়া যায় না। আর Unfriend করলে তো কথাই নেই! প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ দেখে Inbox-এ ‘Rest in peace’ কথাটি লেখারও সময় নেই, তাই সংক্ষেপে ‘RIP’ লিখেই অনেকে দায় সারে। আবার কেউ সেটি ‘copy and paste’ করে ধন্য হন।

ফেসবুক এক ভয়ানক আসক্তি: ফেসবুক ভয়ানক আসক্তির মাধ্যম। কিশোর-কিশোরী থেকে পড়ুয়ারা ফেসবুকের নানা অশালীন দৃশ্য, ভিডিয়ো ইত্যাদি দেখার ফলে তাদের মধ্যে অকালপক্বতা এসে যাচ্ছে। শুদ্ধ-পবিত্র মনগুলি ফেসবুকে নেতিবাচক প্রভাবের ফলে ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদের শিকার হচ্ছে। নিজের প্রচারের কাজটা সেরে কতটা Like, আর কে, কী Comment করল, তা দেখতে গিয়ে আসক্তির চূড়ান্ত সীমা টপকে যায় মানুষ, নিশ্চয়ই এটি আশীর্বাদ নয়?

উপসংহার: হয়তো অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, কিন্তু এটাও মনে রাখা উচিত- যা অতি জনপ্রিয়, তা সবসময় আশীর্বাদ হয় না, কখনো-কখনো অভিশাপ হয়েও দাঁড়ায়।

ূরদর্শন মানবজীবনকে সমস্যা জর্জরিত করে তুলেছে

উত্তর – মতের পক্ষে –

ভূমিকা: এতদিন যা ছিল স্বপ্নকল্পনার বিষয়, তা বাস্তবে রূপায়িত হয় তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে। কিন্তু সমুদ্রমন্থনে যেমন অমৃতের সঙ্গে ওঠে হলাহল, তেমনি সর্বাধিক জনপ্রিয় গণমাধ্যম দূরদর্শন ধীরে ধীরে মানব জীবনকে যেভাবে সমস্যার জর্জরিত করে তুলছে, তার সপক্ষে যুক্তি হল-

মানুষকে নেশাগ্রস্ত করা: দূরদর্শন যতই জনপ্রিয় হোক না কেন এর কিছু সীমাবদ্ধ দিক রয়েছে। দূরদর্শন এমন একটি গণমাধ্যম যার সামনে একবার বসলে উঠে যাওয়ার ইচ্ছা হয় না। নেশাচ্ছন্ন মানুষের মতো একাসনে বসে একটির পর একটি অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে সময় গড়িয়ে যায়। কারও ভূক্ষেপ থাকে না সময়জ্ঞান সম্পর্কে। ‘রিয়েলিটি শো’ হোক আর মজাদার কোনো অনুষ্ঠানই হোক, টিভির সামনে একবার বসলে কারও ওঠার নামগন্ধ থাকে না। বাড়ির বড়োদের টিভি দেখার অতিরিক্ত নেশার কারণে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও সন্ধ্যার পর পড়তে বসল কি না সে-বিষয়ে বিন্দুমাত্র নজর থাকে না।

পঠন-পাঠনের ক্ষতিকারক: দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখার আগ্রহ নিয়ে ইউনিসেফ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে টিভির প্রোগ্রাম দেখার জন্য প্রায় ৫৭% পড়ুয়া বাড়িতে ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। এমনকি বিদ্যালয়ে দেওয়া হোমওয়ার্ক পর্যন্ত করতে পারে না। পড়াশোনার পরিবর্তে, ঘড়ি ধরে কখন কোন্ অনুষ্ঠান আছে, সেদিকে ছাত্রছাত্রীদের অতিরিক্ত আকর্ষণ দেখা যায়। রিপোর্ট অনুযায়ী, দূরদর্শনের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে প্রায় ৫৫% ছাত্রছাত্রী পড়াশোনার প্রতি বিমুখ, যা সন্তোষজনক নয়।

শারীরিক-মানসিক বিকাশের অন্তরায়: একটা সময় ছাত্রছাত্রীরা নানা রকম সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকত। কেউ খেলাধুলা করে বড়ো খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখত। কেউ ড্রইং-এর সামগ্রী নিয়ে অঙ্কনে, আবার কেউ নৃত্যগীত চর্চায় যেত। ছোটোরাও হয় পার্কে, নয়তো মাঠে খেলত। ফলে দেহের বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশও ঘটত। কিন্তু দূরদর্শনের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণের ফলে সে দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।

নৈতিক অধঃপতনের কারণ: সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনে দূরদর্শনের ভূমিকা কম নয়। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। কাজেই দূরদর্শনের প্রচারিত হওয়া বিভিন্ন দুঃসাহসিক দৃশ্য দেখার পর তা, অনুকরণ করতে গিয়ে অনেক সময় বিপদ ঘটে। আবার বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত এমন কিছু দৃশ্য, যা ছোটোদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমনকি দূরদর্শনে প্রদর্শিত হওয়া সিনেমায় মারপিটের দৃশ্য, গোলাগুলির দৃশ্য নবীন প্রজন্মকে বিপথে নিয়ে যেতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। তাই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য দূরদর্শনের দায় কম নয়।

পারিবারিক অশান্তির কারণ: নিজের পছন্দমতো দূরদর্শনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা নিয়ে পরিবারে একটা ঠান্ডা লড়াই থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টিভি-সিরিয়ালের প্রভাবে সাংসারিক জীবনের শান্তি বিঘ্নিত হয়। এমনকি দূরদর্শনের পরকীয়া সম্পর্ক দেখে সমাজজীবনে তার প্রতিফলন ঘটে থাকে। অনেকে দিনভর টিভির নানা অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে মানসিকভাবে ক্লান্তও হয়ে পড়েন। অবসাদগ্রস্ত হন। তখন পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অশান্তির সৃষ্টি হয়।

উপসংহার: অধুনা কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ দূরদর্শনকে তাদের বাণিজ্যিক কাজে লাগাচ্ছে। নষ্ট করছে সামাজিক মর্যাদা। টেলিভিশনের অবনমন দেখে মার্কিন শিক্ষাবিদ Nicholas Johnson-এর ভাষায় বলতে হয়- “All television is educational television. The question is: what is it teaching?” এমন প্রশ্ন আমার মনেও জাগে। এজন্য বলা যায়, দূরদর্শন মানবজীবনে যতই আনন্দের আয়োজন করে থাক না কেন, তার কুপ্রভাব কোনো অংশে কম নয়।

মতের বিপক্ষে –

ভূমিকা: দূরদর্শন আধুনিক গণমাধ্যমের অন্যতম একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। কেউ কেউ দূরদর্শন সম্পর্কে বলে থাকেন-“Television is the third parent.” কিন্তু অনেকে দূরদর্শনের অপকারিতা নিয়েও উচ্চকিত। কিন্তু আমি মনে করি দূরদর্শন মানবজীবনকে মোটেও সমস্যার জর্জরিত করে না, তার যুক্তি হল-

দূরদর্শন নেশার বস্তু নয়: অনেকে হয়তো মনে করেন, দূরদর্শন মানুষকে নেশার মতো আসক্ত করে। কিন্তু অতি জনপ্রিয় এই গণমাধ্যমটি পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে সম্প্রচার করে। বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান থেকে দেশ-বিদেশের খবরাখবর সমীক্ষা বা বিভিন্ন রকমের প্রতিবেদনে টেলিভিশন আমাদের সমৃদ্ধ করে। যে-কোনো বিষয়ের ভালোমন্দ দুটো দিক রয়েছে। সেটা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উপর। তাহলে অকারণ দূরদর্শনের উপর দায় চাপানোর কারণ কী? আবার দূরদর্শনই একমাত্র মাধ্যম নয় যা মানুষকে আসক্ত করে। অহেতুক নিজেকে আসক্ত করে দূরদর্শনের উপর দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।

দূরদর্শন শিক্ষা সহায়ক : হয়তো অনেকে মনে করেন, বাড়িতে টেলিভিশন থাকার ফলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। এ কথা সত্য নয়। শিশুকে শান্ত রাখতে চালানো হয় বিভিন্ন প্রকার কার্টুন চ্যানেল। এর জন্যও দূরদর্শন দায়ী? সচেতন অভিভাবকরা পঠন-পাঠনের সময় দূরদর্শন বন্ধ রাখেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয়। সেগুলি সময় মতো দেখলে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হয় না। সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হলে সেটি ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেও শিক্ষামূলক বিষয় হয়ে ওঠে। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের খেলা নবীন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে।

নৈতিক অধঃপতনের কারণ নয়: মোবাইল ফোনে আজ সবকিছু সহজেই হাতের মুঠোয় এসে যায়। এমনকি বাড়ির ছোটোদের হাতেও স্মার্টফোন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগে বাড়িতে কোনো অতিথি এলে সকলে মিলে টিভির অনুষ্ঠান দেখত। আনন্দ-বিনোদনের নানা অনুষ্ঠানে মনটা উৎফুল্ল হত। আর এখন মোবাইল ফোনে দুটি চোখ আটকে থাকে। কাজেই দূরদর্শন নয় যদি নৈতিক অধঃপতন ঘটে তবে মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য ডিভাইসের কথা বলতে হয়।

দূরদর্শন পারিবারিক সম্পর্ক মজবুত করা : অনেকে মনে করেন দূরদর্শনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারিবারিক অশান্তির অভিনয় দেখে ঘরেও অশান্তির আগুন জ্বলে। এটা ঠিক নয়। সারাদিন ঘরেবাইরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দিনটা অতিবাহিত হয়। সন্ধ্যার পর ঘরে বসে সপরিবারে একসঙ্গে থাকার সুযোগ করে দেয় এই দূরদর্শন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভালোমন্দ বাছবিচার-সহ হাস্যকৌতুকের অনুষ্ঠানে : সপরিবারে হেসে উলটে পড়ে। টেলিভিশন না থাকলে কথা কাটাকাটি তর্ক-বিতর্কে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হত। বরং টিভি চললে সবার চোখ সেখানে নিবদ্ধ থাকে। তর্ক-বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকে না।

দূরদর্শন একের মধ্যে অনেক: দূরদর্শন হল এমন এক সক্রিয় গণমাধ্যম, যার মাধ্যমে ঘরে বসে বিশ্বদর্শন সম্ভব। দেশবিদেশের চটজলদি খবর, অবসর সময়ে সপরিবারে বসে সিনেমা দেখার সুযোগ টেলিভিশনেই সম্ভব। সম্প্রতি প্রায় প্রতিটি ঘরে অ্যান্ড্রয়েড টিভি এসে গেছে। যার ফলে নিজের ইচ্ছেমতো স্মার্টফোন থেকেও টেলিভিশন সেটে শিক্ষামূলক বিষয় দেখা যাবে। আবার কখনও বাড়িতে একা থাকলে দূরদর্শন হয়ে ওঠে নিকট বন্ধু, জীবনের সঙ্গী।

উপসংহার: যে-কোনো বিষয়ের ভালোমন্দ দুটো দিক থাকে। সেটা নির্ভর করে ব্যবহারের উপর। টিভির সামনে বসে অকারণ দূরদর্শনকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। বরং টেলিভিশনে এমন কিছু মজার মজার অনুষ্ঠান থাকে, যা দেখলে মনের দুঃগুলো দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। সুতরাং টেলিভিশন মানবজীবনকে সমস্যা জর্জরিত করে না, সমস্যার – মুক্তি এনে দেয়।

ধুনিক জীবনে বৃদ্ধাবাস অপরিহার্য

উত্তর মতের পক্ষে

ভূমিকা: নচিকেতা তাঁর গানের ভাষায় লিখেছেন- “স্বামী স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ান, জায়গা বড়োই কম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।” বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা বিপত্নীক বাবা বা বিধবা মায়ের দেখভাল করার কেউ নেই বা লোকের বড়োই অভাব। সুতরাং যেসব কারণে আমি মনে করি আধুনিক জীবনে বৃদ্ধাবাস অপরিহার্য, তা হল-

পারিবারিক বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি: বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। অথচ কর্মব্যস্ত সন্তান সে দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়। কখনও দেখা যায়, বিপত্নীক বাবা কিংবা বিধবা মা ছোট্ট পরিবারে বোঝার মতো হয়ে ওঠেন। বিবাহিত ছেলে ঘরে থাক বা প্রবাসেই থাক, বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। অবহেলা, অযত্ন কিংবা সন্তানের বিবাহিত জীবনের সুখশান্তির দিকে তাকিয়ে স্বীকার করতেই হয়, পারিবারিক বিড়ম্বনা থেকে মুক্তির একমাত্র ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম।

একাকিত্ব মোচন: অনেক সময় একই পরিবারে পুত্র এবং পুত্রবধূ দুজনেই কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে থাকেন। তখন বার্ধক্যে উপনীত পিতা-মাতার কাছে সারাটা দিন যেন একা একা মনে হয়। সময় যেন কাটতেই চায় না। তখন সেই একাকিত্ব মোচনের জন্য বৃদ্ধাবাস অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে সমমনোভাবাপন্ন এবং সমবয়সি মানুষেরা যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে জীবনের উপসংহারে উপনীত হন। কাজেই একা একা থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে সমবয়সিদের সঙ্গে একাকিত্ব মোচনের আকাঙ্ক্ষাতেই গন্তব্য হয়ে ওঠে বৃদ্ধাবাস।

সহানুভূতির শেষ ঠিকানা : মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই যেন ফিরে আসে শৈশবের মতো সেই জীবনাচরণ। মান-অভিমান বাড়তে থাকে। মনে হয় তাঁরা ব্রাত্য। কিন্তু সেই মান-অভিমান থেকে মুক্তিদাতার বড়োই অভাব। শরীরের সামর্থ্য কমতে থাকে, নানা অসুখবিসুখ শরীরে দানা বাঁধলে সমস্যা আরও বাড়ে। সময়মতো জোটে না চিকিৎসা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পূজা’ পর্যায়ের গানের যেমন লিখেছেন-“জীবন যখন শুকায়ে যায়। করুণাধারায় এসো।” ঠিক তেমনি বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর বৃদ্ধ পিতামাতার সহানুভূতির শেষ ঠিকানা হয়ে ওঠে বৃদ্ধাশ্রম।

কিছুটা মুক্তি কিছুটা স্বস্তি: সংসারজীবনের ঘানি টানতে গিয়ে যখন ক্লান্তি এসে জমা হয়, তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে কিছুটা মানসিক শান্তির, কিছুটা স্বস্তির। আবার পরিবারের কাছে যখন বৃদ্ধ বৃদ্ধারা নিতান্ত কর্তব্যপালনের বোঝা হয়ে ওঠেন, তখন সন্তানের আচরণ দেখে মানসিক কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বৃদ্ধাবাসের আশ্রয়ই শ্রেয় মনে হয়। তাতে ছেলে বা মেয়ের মানসিক স্বস্তি যেমন আসে, তেমনি বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার অবশিষ্ট জীবন থেকে নানান সমস্যার মুক্তি ঘটে। মানসিক চাপ কমে উপলব্ধ হয় স্বস্তি।

ভালো রাখা ও ভালো থাকার আশ্রয় : অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, ছেলে কর্মসূত্রে বিদেশে কিংবা দেশের এখানে-ওখানে দিনভর ব্যস্ত। পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি বা শ্রদ্ধার কমতি নেই। কিন্তু সময়ের বড়ো অভাব। সেক্ষেত্রে নিজের বিবাহিতা কন্যা হোন, কিংবা কর্মব্যস্ত পুত্রই হোন বৃদ্ধ বাবা-মা-কে নিয়ে তাদের মনেও শান্তি খুব-একটা থাকে না। সেক্ষেত্রে বরং বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে নিয়মিত খোঁজখবরসহ আর্থিক সাহায্য করার মাধ্যমে বাবা-মা যেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভালো থাকার অবলম্বন খুঁজে পান, এমনটা মনে হয়। তখন বৃদ্ধাশ্রমের কথা ভাবতেই হয়।

উপসংহার: সুতরাং এসব দিক বিবেচনা করে আমি মনে করি, বার্ধক্যে পৌঁছে পরনির্ভরতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বয়স্ক পিতামাতার জন্য বৃদ্ধাবাস আধুনিক জীবনে এক অপরিহার্য ঠিকানা।

মতের বিপক্ষে –

ভূমিকা: কথায় বলে- “বাড়ি যদি মন্দির হয়, তবে মা-বাবা ভগবান।” অথচ বাবা-মা বার্ধক্যে পৌঁছোনোমাত্রই তাদের নিয়ে শুরু হয় নানান জল্পনা-কল্পনা। ছোট্ট পরিবার, সুখী পরিবার-এই ভাবনা ভাবতে গিয়ে অনেক সন্তান ভেবেই বসেন যে, বৃদ্ধ পিতা-মাতার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সর্বোত্তম ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম। কিন্তু আমি মনে করি, আধুনিক জীবনে বৃদ্ধাবাস কখনোই অপরিহার্য নয়, তার যুক্তি হল-

দায় এড়ানোর অজুহাতমাত্র: পরিবারের মধ্যেই বয়স্ক বাবা-মাকে রেখে তাদের পরিচর্যা করার যে স্বর্গীয় সুখ, সেই অনুভূতি যখন থাকে না তখন পিতা-মাতার প্রতি নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তাঁরা নানা যুক্তি উপস্থাপন করেন। এর একমাত্র কারণ হল, নিজেদের দায় অস্বীকার করা। আমাদের মনে রাখা উচিত, দেশটা এখনও বৃদ্ধাশ্রমে ভরে ওঠেনি। নিজের পারিবারিক সুখের কথা ভেবে অনেকে বয়স্ক মা-বাবাকে বৃদ্ধাবাসে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করে দেন। এমন মানসিকতা হল সর্বনাশা ভাবনার প্রতিফলন।

ছোটো পরিবার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা: অনেকে মনে করেন, ছোটো পরিবার বলতে নিজের স্ত্রী এবং সন্তান এটুকুই। সেখানে পোষ্য কুকুরের, পাখির, মাছের, ফুলের টবের অঢেল জায়গা থাকতে পারে কিন্তু যে বাবা-মা লালনপালন করেছেন, তাকে বড়ো করেছেন তাঁদের জন্য পরিবারের কোনো স্থান তাঁরা আর যখন সংসারে অপরিহার্য বলে বিবচিত হয়ে না, তখন সেটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী? ছোটো পরিবার মানে বৃদ্ধ পিতামাতাকে বাদ দিয়ে কোনো পরিবার হলে, তা পরিপূর্ণতা পেতে পারে না।

প্রয়োজন পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি: পিতা-মাতার প্রতি যদি অসীম শ্রদ্ধা-ভক্তি ও আন্তরিকতা থাকে, তবে প্রবাসে থেকেও নিজের বাড়িতে বয়স্ক পিতা-মাতার পরিচর্যা করার দিব্যি ব্যবস্থা করা যায়। কারণ, আজকাল টাকা খরচ করলে সবকিছুই হাতের মুঠোয় এসে যায়। আবার বৃদ্ধাশ্রমেও তো টাকাপয়সা জোগান দিতে হয়। হয়তো তার চেয়ে একটু বেশি খরচ করলে বাড়িতেই বাবা-মা যাতে পরম শান্তিতে তাঁদের শেষজীবন অতিবাহিত করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা যায়। সৌভাগ্য হাতছাড়া করা একদমই উচিত নয়।

সমবয়স্ক মানেই সমমনোভাবাপন্ন নয় : সমবয়স্ক বৃদ্ধবৃদ্ধারা যে সমমনোভাবাপন্ন হবেন, এমন চিন্তাভাবনার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ ছাড়াও বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাঁদের দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন পরিবারের মধ্য থেকে, হঠাৎ করে বৃদ্ধাবাসে উপস্থিত হওয়ার পর অন্য বয়স্কদের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করার কাজটা বেশ কঠিন। সেখানে রয়েছে পরিবার থেকে ব্রাত্য হওয়া, হতাশায় ভরা এক ঝাঁক মুখ। তাদের মধ্যে কৃষ্টি-কালচার, রুচি, পারিবারিক সংস্কৃতির অনেক ফারাক থাকা স্বাভাবিক। সুতরাং আধুনিক জীবনে বৃদ্ধাবাস কখনোই অপরিহার্য নয়।

পারম্পরিক সম্পর্ক: ভারতীয় সংস্কৃতিতে রয়েছে পারম্পরিক সম্পর্কে এক অমলিন ঐতিহ্য। অতীত সময় থেকে একই পরিবারের একাধিক সন্তান নিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের বিন্যাস ভারতীয় তথা বঙ্গ জীবনের অতি পরিচিত দৃশ্য।এক অন্নে, এক সংস্কৃতিতে লালিত সংসারে ছিল পরমসুখ। কিন্তু বিজ্ঞানপ্রযুক্তির যুগে সন্তানেরা পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে নিজেদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে মেকি মুখোশ-পরা ব্যবস্থাপনার কথা ভাবছেন। মনে রাখা উচিত, বাবা-মায়ের বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই আপনজনকে আঁকড়ে ধরে তাঁরা বাকি জীবনটা কাটাতে চান। সেখানে নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় কাটানোর মতো আনন্দ পিতা-মাতা কি দাবি করতে পারেন না?

উপসংহার: বয়স্ক পিতা-মাতা হয়ে উঠুন আমাদের পরামর্শদাতা। তাঁদের অভিভাবকত্বে আমরা আরও পরিণত হই। আমাদের সন্তানেরাও দেখুক, বয়স্ক মা-বাবার প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ। গড়ে উঠুক পারম্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন। তাই তাঁদের অন্তিম জীবন কাটুক পরিবারেই, বৃদ্ধাশ্রমে নয়।

আরও পড়ুন

তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্প প্রশ্ন উত্তর

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

ছুটি গল্পের বড়ো প্রশ্ন উত্তর

লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন উত্তর

নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর

বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর

আজব শহর কলকেতা প্রশ্ন উত্তর

আড্ডা প্রশ্ন উত্তর

পঁচিশে বৈশাখ প্রশ্ন উত্তর

বাংলা গদ্য প্রবন্ধের ধারা প্রশ্ন উত্তর

বাংলা কাব্য কবিতার ধারা প্রশ্ন উত্তর

বাংলা নাট্য সাহিত্যের ধারা প্রশ্ন উত্তর

উপন্যাস ও ছোটোগল্পের ধারা প্রশ্ন উত্তর

YouTube – Samim Sir

Leave a Comment