উপন্যাস ও ছোটোগল্পের ধারা প্রশ্ন উত্তর // Class 11 2nd Semester // Class 11 Bangla Sahityer Itihas Semester 2
উপন্যাস ও ছোটোগল্পের ধারা
5 মার্ক প্রশ্ন উত্তর
(১) বাংলা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো । ৫
উত্তর – বাংলা উপন্যাসের জনক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘Rajmohan’s Wife’। এটি ঐতিহাসিক রোমান্স নয়, বাস্তব জীবনের গল্প। তাঁর যথার্থ প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’র রচনা অবশ্য তার আগেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। মধ্যবর্তী বাইশ বছরের মধ্যে তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা চোদ্দো। সেই উপন্যাসগুলির শ্রেণি ও সময়কাল নিম্নরূপ:
(ক) ইতিহাস ও রোমান্সধর্মী উপন্যাস: ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯), ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪), ‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), ‘সীতারাম’ (১৮৮৭)।
(খ) তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস: ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪), ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪)।
(গ) সমাজ ও গার্হস্থ্যজীবনধর্মী উপন্যাস: ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩), ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩), ‘রজনী’ (১৮৭৭), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮), ‘রাধারাণী’ (১৮৮৬)।
এর মধ্যে প্রথমোক্ত শ্রেণির উপন্যাসগুলির মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র মূলত ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রণে সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক রোমান্সের পরিচয় দিয়েছেন।
দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণির উপন্যাসে যে-তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধের কথা বর্ণিত। ‘আনন্দমঠ’-এর কেন্দ্রে তিনি রেখেছেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহ আর সুপরিচিত ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীত।
তবে বঙ্কিমের শেষোক্ত শ্রেণির উপন্যাসগুলিতে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে তাঁর বাস্তব জীবন ও জগতের প্রতি পর্যবেক্ষণ, মানুষের গভীর মনস্তত্ত্ব আর বর্ণনভঙ্গিমা। তবে কোথাও কোথাও শিল্প অপেক্ষা নীতিকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য তাঁর উপন্যাস প্রচারধর্মী ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনে হয়েছে।
পরিশেষে এ কথা বলতে হয় যে, তাঁর উপন্যাস প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বহু বিদেশি লেখকের নাম উল্লেখিত হয়, যেমন-স্কট-ডিকেন্স কিংবা জোলা-বালজাক-ফ্লবেয়র প্রমুখ। কারণ বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সৃষ্টিকর্মে কোথাও কোথাও তাঁদের অনুসরণ করেছেন। তবে সামগ্রিক বিচারে তিনি যা-ই লিখেছেন, তাতে সময়ের প্রেক্ষিতে তাঁকে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা অসমীচীন হবে না।
(২) ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা করো । ৫
উত্তর – ভূমিকা: বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব আকস্মিক নয়, আকাঙ্ক্ষিত। তাঁর জনপ্রিয়তা কেবল কথাশিল্পীর অনুরাগের সহজ আলপনায় নয়, তাঁর জনপ্রিয়তা আরও কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে আছে। সমাজ অননুমোদিত প্রেমের বিশ্লেষণ এবং সমাজসংস্কার ও আচার-আচরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে গিয়েছে।
উপন্যাসসমূহ: শরৎচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল – ‘বড়দিদি’ (১৯১৩), ‘পণ্ডিতমশাই’ (১৯১৪), ‘অরক্ষণীয়া’ (১৯১৬), ‘পল্লীসমাজ’ (১৯১৬), চার পর্বে বিভক্ত ‘শ্রীকান্ত’ (১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭, ১৯৩৩), ‘দেবদাস’ (১৯১৭), ‘চরিত্রহীন’ (১৯১৭), ‘গৃহদাহ’ (১৯২০), ‘দেনাপাওনা’ (১৯২৩), ‘শেষ প্রশ্ন’ (১৯৩১), ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯২০), ‘পথের দাবী’ (১৯২৬) প্রভৃতি।
শরৎচন্দ্র সমাজনিষিদ্ধ প্রেমের বিশ্লেষণে সিদ্ধহস্ত। ‘গৃহদাহ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘পল্লীসমাজ’ প্রভৃতি উপন্যাসের কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয়।
শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে আবেগ-উচ্ছ্বাসের অতিরেক দেখা যায়। এ কারণেই তাঁর গল্প-উপন্যাস বাঙালি হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছিল। তাঁর প্রেমভিত্তিক উপন্যাসের মধ্যে ‘দেবদাস’, ‘পরিণীতা’, ‘গৃহদাহ’, ‘দত্তা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দেশপ্রেম তথা সহিংস বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে রোমান্সের মিশ্রণ ঘটেছে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, ‘অরক্ষণীয়া’, ‘গৃহদাহ’ প্রভৃতি উপন্যাসে। চার পর্বে বিভক্ত ‘শ্রীকান্ত’ তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস।
শরৎ উপন্যাসে বোহেমিয়ান সমাজ ইতিহাসের কিছু চরিত্র লক্ষ করা যায়। যেমন-‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে শ্রীকান্ত চরিত্রটি।
শরৎচন্দ্র বিধবা চরিত্রগুলিকে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে অঙ্কন করেছেন। যেমন-‘বড়দিদি’র বড়দিদি, ‘পল্লীসমাজ’-এর রমা, ‘শ্রীকান্ত’-এর কমললতা, ‘গৃহদাহ’র মৃণাল, ‘শেষ প্রশ্ন’র কমল প্রমুখ। অবশেষে বলা যায়, সরল আকর্ষণীয় রচনারীতি এবং আবেগের আন্তরিক প্রকাশ শরৎ-উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কেন্দ্রীয় কারণ।
(৩) কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের কয়েকটি বিখ্যাত ছোটোগল্প সম্পর্কে আলোচনা করো । ৫
উত্তর – বিখ্যাত ছোটোগল্প: শরৎচন্দ্র কথাশিল্পের জাদুদণ্ড দিয়ে বাংলা সাহিত্যের পাঠকসমাজকে বশ করেছেন। কিন্তু তিনি উপন্যাস রচনায় যতটা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, ছোটোগল্পে সেভাবে প্রভাব রাখতে পারেননি। তাঁর গল্পগুলি ছোটোগল্পের চরিত্রধর্মিতার প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। যেমন-‘রামের সুমতি’ (১৯১২), ‘বিন্দুর ছেলে’ (১৯১৪), ‘মেজদিদি’, ‘মামলার ফল’ (১৯২০) প্রভৃতি গল্পে উপন্যাসের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পদুটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম সারির ছোটোগল্প। নিম্নে কয়েকটি ছোটোগল্প সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
মহেশ: ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘মহেশ’ গল্পে শরৎচন্দ্র একটি মানবেতর প্রাণীকে কাহিনির কেন্দ্রে রেখে জমিদারি শোষণে এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অত্যাচারে ক্লিষ্ট, অসহায় মানুষের জীবনের করুণ পরিণতিকে তুলে ধরেছেন।
অভাগীর স্বর্গ: জমিদারি শোষণ-শাসনের আর-একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হল ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটি। এ গল্পের কাহিনি ও সমাজভাবনা আমাদের স্তম্ভিত করে।
অন্যান্য গল্প: ‘মন্দির’, ‘বড়দিদি’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘রামের সুমতি’ প্রভৃতি গল্প মনে করিয়ে দেয় শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যের নায়ক চরিত্রের সাধারণ লক্ষণ উদাসীনতা এবং সাংসারিক বিবেচনাহীনতাকে।
ছোটোগল্পের প্রচলিত আদর্শকে সামনে রেখে তাঁর গল্পের মূল্যায়ন করতে গেলে হয়তো হিসেব সবক্ষেত্রে সফলতা মিলবে না, কিন্তু তাঁর গল্পগুলি যে সুখপাঠ্য ও একান্তভাবেই সমাজকেন্দ্রিক-এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
(৪) প্রধান প্রধান উপন্যাসের নাম উল্লেখ করে কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশিষ্টতা সংক্ষেপে আলোচনা করো । ৫
উত্তর – উপন্যাসসমূহ: রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যধারায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি জীবনের গদ্যময় বাস্তবতাকে প্রকাশ করেছে। তাঁর প্রধান প্রধান উপন্যাসগুলি হল-‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘অহিংসা’ (১৯৪১), ‘চতুষ্কোণ’ (১৯৪৮), ‘সোনার চেয়ে দামী’ (১৯৫১), ‘শহরতলী’ ইত্যাদি।
তাঁর ‘দিবারাত্রি কাব্য’ উপন্যাসে মানুষের অবচেতন মনের দিকটি দেখানো হয়েছে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে পরিস্থিতির চাপে গ্রামকেন্দ্রিক মানুষের জীবনের জটিলতার দিকগুলি দেখানো হয়েছে। ‘পদ্মানদীর মাঝি’-তে পদ্মাকেন্দ্রিক জেলেমাঝিদের জীবনসংগ্রামের চিত্র সুচারুভাবে অঙ্কিত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বৃত্তিজীবী মানুষের জীবন ও সমাজকে নিপুণ দক্ষতায় অঙ্কন করেছেন। এর মধ্যে কল্পনার রং নেই, আছে বাস্তব সমাজ, বাস্তব জীবন। যেমন-‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬)।
পূর্ববাংলার আঞ্চলিক জনজীবনের ছবি এ উপন্যাসের কেন্দ্রস্বরূপ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের কামপিপাসার জান্তব মূর্তিকে তাঁর বিভিন্ন লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনের তত্ত্ব কমবেশি তাঁর প্রায় সমস্ত উপন্যাসের মধ্যে দেখা যায়। ‘নেকী’, ‘শিপ্রার অপমৃত্যু’, ‘সর্পিল’, ‘বিষাক্ত প্রেম’ প্রভৃতি গল্পে প্রেমের বিচিত্র প্রকাশ আলোচিত হয়েছে। ‘ভূমিকম্প’ গল্পটি মানসিক ব্যধির চমৎকার দৃষ্টান্ত।
পরবর্তী দশকগুলিতে বাংলা সাহিত্যে প্রায় সব শাখাতে যে-প্রাণময় প্রবলতা পরিলক্ষিত হয়, তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা কথাসাহিত্যে আপসহীন, সংগ্রামী মনোভাবের পরিচয় দিয়েই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিত্যকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।
(৫) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম করো । কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর বিশিষ্টতার দিকগুলি উল্লেখ করো। ২+৩
উত্তর – উপন্যাসসমূহ: প্রকৃতির মুগ্ধ দর্শক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) মানবজীবনকে প্রকৃতির প্রেক্ষাপটেই – বিচার করেছেন। প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ ঘটনা, কথাবার্তা, হাঁটাচলা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এসবই তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিষয়। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯), ‘অপরাজিত’ (১৯৩২), ‘আরণ্যক’ (১৯৩৮), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৯৪০), ‘ইছামতী’ (১৯৫০), ‘অশনি সংকেত’ (১৯৫০) প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য: তাঁর উপন্যাসের বিশিষ্টতার দিকগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
তাঁর উপন্যাস পরিচিত বিষয়, দৃশ্য, বিবর্ণ দেশ-কাল-এসবের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রসবস্তু, কঠোর বাস্তবের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রূপলোকের স্বপ্নমাধুরীকে আবিষ্কার করেছে। যেমন-‘পথের পাঁচালী’।
প্রকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয়ের একটি গোপন সংযোগ আছে, তা তিনি তাঁর লেখায় বারে বারে বলেছেন। যেমন-‘আরণ্যক’। এই উপন্যাসে তাঁর ভাবতন্ময়তা লক্ষ করা যায়। সমসাময়িক যুগের রাজনৈতিক অস্থিরতা, জীবনের জটিলতা প্রভৃতি বিষয় তাঁর লেখার মধ্যে সেভাবে পাওয়া যায় না, তিনি একান্তভাবেই প্রকৃতির কবি।
বিভূতিভূষণের রচনায় শিশুচরিত্রগুলি আবহমানকালের বাৎসল্যরসের প্রতিনিধিত্ব করেছে। যেমন-‘পথের পাঁচালী’র অপু। এভাবেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশিষ্টতার দিকগুলিকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
(৬) তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান প্রধান উপন্যাস ও ছোটোগল্পগুলির নাম করো । তাঁর রচনার বিশিষ্টতার দিকগুলি নির্দেশ করো । ২+৩
উত্তর – প্রধান উপন্যাস: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮ – ১৯৭১) রাঢ় বঙ্গের প্রকৃতি-মানুষ-সংস্কৃতির রূপকার। রাঢ়ের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত, সাধারণ মানুষের জীবনের রূপকে তিনি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। তারাশঙ্করের লেখায় কাহার, বেদে প্রভৃতি আদি জনজীবনের ছবি লক্ষ করা যায়। এই সমস্ত সম্প্রদায়ের সংস্কার, বিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান প্রভৃতি লেখক জীবন্তভাবে তুলে ধরেছেন। বিশিষ্ট অঞ্চলের জীবন আর মানুষের চরিত্র চিত্রণে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার জন্যেই তাঁকে আঞ্চলিক ঔপন্যাসিক বলা হয়। তাঁর লেখা উপন্যাসের মধ্যে ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯), ‘কালিন্দী’ (১৯৪০), ‘গণদেবতা’ (১৯৪২), ‘পঞ্চগ্রাম’ (১৯৪৩), ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৭), ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’ (১৯৫২), ‘জনপদ’, ‘পদচিহ্ন’, ‘রাধা’, ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ (১৯৫৫) প্রভৃতি প্রধান।
উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প: তারাশঙ্কর কয়েকশো ছোটোগল্প রচনা করেছেন। উপন্যাস ও ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একই। তাঁর ছোটোগল্পের মধ্যে ‘রসকলি’, ‘রাইকমল’, ‘জলসাঘর’, ‘নারী ও নাগিনী’, ‘তারিণী মাঝি’, ‘রায়বাড়ী’, ‘অগ্রদানী’, ‘ডাইনী’, ‘ছলনাময়ী’, ‘পৌষলক্ষ্মী’ প্রভৃতি প্রধান।
কথাসাহিত্যের বিশিষ্টতা: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস-ছোটোগল্পের মধ্যে নবীন ও প্রবীণের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন। নবীনের কাছে প্রবীণের পরাজয় দেখালেও, প্রবীণের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই সহানুভূতিশীল। মানবজীবনের বিশালতা ও গভীরতাকে তিনি ধ্যানতন্ময়তার সঙ্গে পরিস্ফুট করেছেন। আঞ্চলিক সমাজ ও জীবনকে তিনি নিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষা, উৎসব-অনুষ্ঠান, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন।
(৭) বাংলা গল্পসাহিত্যে পরশুরাম-এর ভূমিকা আলোচনা করো । ৫
উত্তর –গল্পসমূহ: বাংলা গল্প লিখে যিনি হাস্য ও ব্যঙ্গে বাঙালি পাঠককে আমোদিত ও সচকিত করে তুলেছিলেন, তিনি হলেন ‘পরশুরাম’ ছদ্মনাম গ্রহণকারী রাজশেখর বসু। বাংলা সাহিত্যে তাঁর পরিচয় বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গ-তীক্ষ্ণ গল্পের লেখক হিসেবে। তাঁর পরিকল্পনার মৌলিকতার দৃষ্টান্ত ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ গল্পটি। এই গল্পে যৌথ ব্যবসায় ধর্মকেন্দ্রিক জুয়াচুরি প্রবৃত্তিকে আঘাত করা হয়েছে। বাঙালির ব্যাবসাপ্রণালীর ত্রুটিকে আঘাত করতে গিয়ে তিনি এ গল্পে সৃষ্টি করেছেন কয়েকটি আশ্চর্য চরিত্র।
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য: পুরাণকথার মধ্য দিয়ে তাঁর কল্পনা উদ্ঘাটিত করেছে নানান অসংগতি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আবিলতাহীন কৌতুক। ‘জাবালি’, ‘পাঞ্চালী’, ‘তৃতীয় দ্যূতসভা’ গল্পগুলি তার প্রমাণ। পুরাণের এত বিচিত্র এবং সার্থক ব্যবহার রাজশেখর বসুর মতো খুব কম বাংলা গল্পলেখকই করতে পেরেছেন।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় ও সমাজের মানুষ এবং তাদের আচার-আচরণে নীতি ও নীতিভ্রষ্টতার পরিচয় উদ্ভাষিত হয়েছে ‘লম্বকর্ণ’ প্রভৃতি গল্পে। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক আচরণে নিহিত হাস্যরস কেমন করে পরিস্থিতির প্রভাবে ঘনীভূত হয়ে ওঠে, তা তাঁর রচনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
তাঁর গল্পসংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘গড্ডলিকা’ (১৯২৪), ‘কজ্জলী’ (১৯২৭), ‘হনুমানের স্বপ্ন’ (১৯৩৭), ‘গল্প-কল্প’ (১৯৫০) প্রভৃতি। তাঁর লেখাতেও ত্রৈলোক্যনাথের মতো বাস্তব-উপেক্ষাকারী কল্পনা স্থান পেয়েছে। তবে পরশুরামের রচনা বেশ মার্জিত ও সংহত।
(৮) বাংলা কথাসাহিত্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো । ৫
উত্তর – উপন্যাসসমূহ: প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯১৪-১৯৮৮) কবিতা, উপন্যাস, গল্প-সবই সমান দক্ষতায় লিখেছেন। তবে ছোটোগল্পকার ও কবি হিসেবে তিনি বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। দরিদ্র বস্তিবাসী মানুষের নিরুপায় নিষ্ঠুর জীবনযাপন নিয়ে লেখা ‘পাঁক’ (১৯২৬), ‘মিছিল’ (১৯৩৩) প্রভৃতি উপন্যাস সাহিত্যিক মহলে তাঁর পরিচিতি এনে দেয়। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে ‘আগামী কাল’ (১৯৩৪), ‘প্রতিশোধ’ (১৯৪১), ‘প্রতিধ্বনি ফেরে’ (১৯৬১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ‘কল্লোল’ গোষ্ঠী ও পত্রিকার অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ছিলেন তিনি।
গল্পগ্রন্থ: তাঁর গল্প সংকলনের মধ্যে-‘পঞ্চশর’, ‘বেনামী বন্দর’, ‘পুতুল ও প্রতিমা’, ‘মৃত্তিকা’, ‘মহানগর’ প্রভৃতি প্রধান। শুধু ‘কেরাণী’, ‘স্টোভ’, ‘হয়তো’, ‘পুন্নাম’ প্রভৃতি মনস্তত্বভিত্তিক গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ এ গল্পগুলিতে লেখক সহানুভূতির সঙ্গে তুলে ধরেছেন। গল্পগুলির কাহিনি বেশ নিটোল এবং একমুখী, চরিত্রগুলি প্রাণবন্ত। পতিতাদের জীবন নিয়ে তিনি তীক্ষ্ণ সহানুভূতির গল্প লিখেছেন। যেমন-‘মহানগর’, ‘সংসার সীমান্তে’। বিজ্ঞানকে ভিত্তি করেও তিনি সার্থক কৌতুকরসসমৃদ্ধ ছোটোগল্প রচনা করেছেন। প্রসঙ্গত বলা যায়-‘ঘনাদার গল্প’-এর কথা।
প্রেমেন্দ্র মিত্র কথাসাহিত্য সৃষ্টিতে প্রধানত কঠোর বাস্তবকেই অবলম্বন করেছেন। চরিত্র অঙ্কনে কোনোকিছু রাখঢাক করার চেষ্টা করেননি। তিনি তাঁর রচনার মধ্যে জীবনের আশাবাদের দিকটিকে প্রকাশ করেছেন। অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ভাঙা নৌকায় ছেঁড়া পাল তুলে মানবসমুদ্র পার হতে চেয়েছেন।
(৯) বনফুলের উপন্যাস ও ছোটোগল্পগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো । ৫
উত্তর –ভূমিকা: বনফুলের আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯)। বনফুল সমধিক সাহসিকতায় উপন্যাস ও ছোটোগল্প রচনা করেছেন। তবে উপন্যাসের তুলনায় তাঁর ছোটোগল্পগুলি বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ভাভিরার শেকী
উপন্যাসসমূহ: তাঁর উপন্যাসের মধ্যে পক্ষীবিদ্যা নিয়ে লেখা ‘ডানা’ (১৯৪৮-১৯৫০); মানবসভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘স্থাবর’ (১৯৫১), বিশ শতকের চলমান জীবনের মহাকাব্য ‘জঙ্গম’ (১৯৪৩ ও ১৯৪৫); রাজনীতি বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা ‘সপ্তর্ষি’ (১৯৪৫) এবং ‘অগ্নি’ (১৯৪৬) ইত্যাদি প্রধান। বনফুলের উপন্যাসগুলি কাহিনি বয়নে, চরিত্র নির্মাণে এবং মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। এ ছাড়াও ‘ভূবনসোম’ (১৯৫৬), ‘অগ্নীশ্বর’ (১৯৫৭), ‘হাটে বাজারে (১৯৬১) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস।
ছোটোগল্পসমূহ: ছোটোগল্প রচনার ক্ষেত্রে তিনি এক নতুন পথের যাত্রী। ছোটো ছোটো একপৃষ্ঠার গল্পের শিল্পসফল লেখক হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে স্মরণীয়। সমাজের অসহায়ক্লিষ্ট মানুষের জীবনকে, সমাজের স্বার্থপরতাকে তির্যকভাবে তিনি ‘বুড়িটা’ গল্পে তুলে ধরেছেন। মিথ্যা পাশ্চাত্য অনুকরণ ও আদর্শবান বাঙালি চরিত্রকে তুলে ধরেছেন তাঁর ‘শ্রীপতি সামন্ত’ গল্পটিতে।
ছোটোগল্প রচনায় বনফুল বিষয় ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের সন্ধানী। তাঁর অতি ছোটোগল্পের বিষয়েও বৈচিত্র্য আছে। ছোটোগল্পের পাশাপাশি তিনি বড়োগল্পও রচনা করেছেন। যেমন-‘টাইফয়েড’, ‘অর্জুন মণ্ডল’ প্রভৃতি। বনফুল রচিত কয়েকটি গল্পগ্রন্থ হল-‘বিন্দুবিসর্গ’, ‘বাহুল্য’, ‘নবমঞ্জরী’, ‘সপ্তমী’, ‘দূরবীন’, ‘অলঙ্কারপুরী’ প্রভৃতি। তাঁর গল্পে মানুষের জীবনের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ উভয়দিকই রূপায়িত হয়েছে। তাঁর গল্পের ভাষা সহজসরল ও ব্যঞ্জনাময়। সব মিলিয়ে বলা যায়, আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে বনফুল অনন্য।
আরও পড়ুন –
তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্প প্রশ্ন উত্তর
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর
লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন উত্তর
বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর
বাংলা গদ্য প্রবন্ধের ধারা প্রশ্ন উত্তর
বাংলা কাব্য কবিতার ধারা প্রশ্ন উত্তর
বাংলা নাট্য সাহিত্যের ধারা প্রশ্ন উত্তর
YouTube – Samim Sir