লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন উত্তর // একাদশ শ্রেণী দ্বিতীয় সেমিস্টার // lalon shah fakirer gaan class 11 question answer // Semester 2

লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন উত্তর // একাদশ শ্রেণী দ্বিতীয় সেমিস্টার // lalon shah fakirer gaan class 11 question answer // Semester 2

লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন উত্তর

Mark – 2 + 3

(১) লালন শাহ্ কে ছিলেন ? পাঠ্য লালন-গীতিকা অবলম্বনে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করো। [সংসদ নমুনা প্রশ্নপত্র] ২+৩=৫

উত্তর – বাউল সাধক লালন শাহ্ ফকির ছিলেন বাউলদের সাধক শিরোমণি। তাঁর জন্ম ও জাতি পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে।

জন্ম-পরিচয় : আনুমানিক ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে (১৭৭৫) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান ভেড়ারা গ্রাম। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল একশো ষোলো বছর। প্রচলিত মতে, তিনি ছিলেন হিন্দু। জনশ্রুতি, তীর্থযাত্রায় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাঁকে ত্যাগ করেন। এক মুসলমান পরিবারের আশ্রয়ে ও শুশ্রুষায় আরোগ্য লাভ করেন। দীক্ষা নেন সিরাজ সাঁইয়ের কাছে।

মানুষকে সাধনা: লালন-গীতিকার মূল বিষয়টি পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করে তিনি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন মানুষকে সাধনা করলে তবেই সোনার মানুষ হওয়া সম্ভব।

মুরশিদের অবস্থান: সোনার মানুষের সন্ধান সাধকের অন্বিষ্ট। তিনি থাকেন সাধারণ মানবশরীরে। মানুষকে অবজ্ঞা করলে সোনার মানুষের সন্ধান মিলবে না।

আজ্ঞাচক্র: আজ্ঞাচক্রে মনের মানুষ অবস্থান করেন। তাঁর সন্ধান বিশেষ পথে শিষ্যকে অর্জন করতে হবে। যে দ্বি-দলের মৃণালে মনের মানুষ অবস্থান করেন-সেখানে পৌঁছোনো সহজ নয়। গুরুর কৃপায় সেখানে পৌঁছোনো যেতে পারে।

মানবশরীরকে মর্যাদা: লালন শাহ্ আরও নির্দেশ দিয়েছেন, খ্যাপা যেন মানব শরীরকে অবমাননা না করেন। মানুষ-গুরুই পরম-গুরুর প্রতিনিধি। আলেক লতার মতো এঁর আদি-অন্ত নেই।

মানুষ-গুরুর নির্দেশ পালন: মানুষ-গুরুর দেখানো পথে সাধক সিদ্ধিলাভ করবে। অন্যথায় সাধকের পক্ষে কোনোদিনই ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান পাওয়া সম্ভব হবে না।

() ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান রচনাটির নামকরণের সার্থকতা মূল্যায়ন করো

উত্তর

নামকরণ রীতি: নামকরণ যে-কোনো শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক। নানা দিক থেকে এই নামকরণ হয়। চরিত্রকেন্দ্রিক, ঘটনাধর্মী, সময়নির্ভর, ব্যঞ্জনাধর্মী, গঠনগত ইত্যাদি।

শিল্পীর অভিপ্রায় ও বিষয় ধারণা: নামকরণে নামদাতার অভিপ্রায়টিই মূর্ত হয়ে ওঠে। পাশাপাশি রচনাবস্তুটি সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণা পাওয়া যায়। পাঠ্য ৩৯১ সংখ্যক গানটির নির্দিষ্ট কোনো শিরোনাম নেই। পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এর নামকরণ করেছেন-‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’।

বাউল সাধনার গূঢ় তত্ত্বের গান: গানটি বাউলদের সাধনতত্ত্বের শিল্পরূপ। কিছু পারিভাষিক শব্দ এ গানটিতে আছে। পৃথিবীর সর্বত্র ধর্মীয় তাগিদ থেকে গান রচিত হয়েছিল। সুতরাং সেদিক থেকে রচনাটির গান হতে কোনো বাধা থাকে না।

গুরুবাদী সাধন সংগীত: বাউলগান গুরুবাদী সাধনসংগীত। পারিভাষিক শব্দ রচনাটিতে পরিচর্যা পেয়েছে। যেমন-সোনার মানুষ, খ্যাপা, দ্বি-দল মৃণাল, মানুষ-গুরু, আলেক লতা, শূন্যকার, মানুষ-আকার, তরবি ইত্যাদি। ফকির লালন শিষ্যপক্ষ খাড়া করে, বাউল-সাধনা কীভাবে করা যায়, সাধনার পথে বাধা কোনগুলি, সেগুলি আলোচনা করেছেন।

পরমের সন্ধান ও আত্মসমীক্ষা: একই সঙ্গে আত্ম – সমীক্ষাও করেছেন। যেহেতু লালন শাহ্ সাধক বাউল, সে-কারণে তাঁর গানে গভীর সাধন কথা এসেছে। দীক্ষিত ছাড়া যেসব শব্দের অর্থ উপলব্ধি সম্ভব নয়। বস্তুত বাউলদের রচনা সুরাশ্রিত। শ্রুতি-পরম্পরায় শিষ্যদের শোনানো হত, সেদিক নামকরণ হয়ে শিল্পসম্মত।

() “মানুষ ছাড়া মন আমার পড়বি রে তুই শূন্যকার”- কথাগুলি কার উদ্দেশে বলা হয়েছে এবং শূন্যকার কী ? মনের শূন্যকার-এ পড়া বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? ২+৩=৫

উত্তর ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এর এই অংশটি সাধক লালনের আত্মজিজ্ঞাসায় ঋদ্ধ। নিজের তথা যে-কোনো বাউল, যাঁরা সাধন-প্রত্যাশী, তাঁদের উদ্দেশে কথাটি বলা হয়েছে।

শূন্যকার: শূন্যকার হল বৌদ্ধদর্শনের একটি পারিভাষিক শব্দ।

হ্যাঁ-না-এর দোলাচলতা: ‘শূন্যকার’ বলতে বোঝায় যা হ্যাঁ-ও নয়, আবার না-ও নয়। বাউল যদি সাধক হিসেবে নিজের দেহকে অবহেলা করেন, তবে এই সাধনায় পরমের সন্ধান তিনি পাবেন না। দেহকে মর্যাদা দিয়ে গুরু নির্দেশিত পথে চললে সাধনায় উত্তীর্ণ হবেন।

শূন্যকারে পড়া”: ‘শূন্যকার’ শব্দটি বিশেষ ব্যঞ্জনার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। মনের দোলাচলতা তথা এক বিচলিত অবস্থা শূন্যকার। এই দোলাচলতায় পড়ে সাধক যদি আপন মানবদেহকে অবহেলা করেন, তাহলে পরমের সন্ধান তিনি পাবেন না। কারণ স্বয়ং ভগবান গুরুরূপে মানবদেহে প্রতিনিধি হিসেবে অবস্থান করেন।

আত্মসাধনাতেই মনের মানুষের সন্ধান: বাউলদের সাধনা গুরুবাদী ও দেহকেন্দ্রিক সাধনা। তাই গুরুই পাবেন সাধককে সুষ্ঠু পথে পরিচালিত করে পরম-গুরুর সন্ধান দিতে। সেই পরম-গুরু থাকেন সাধক-শিষ্যের নিজস্ব শরীরে। সাধকের তাই প্রাথমিক দরকার দেহসাধনা তথা আত্মসাধনা। দেহকে অবহেলা করার অর্থ দেহলীন পরমকে অবমাননা। একই সঙ্গে মানুষ-গুরুকে অবমাননা করা। এমন অবস্থায় সাধক দোলাচলতায় বা ‘শূন্যকার’-এ পড়বে। তখন ‘মনের মানুষ’কে আর পাওয়া যাবে না।

() “লালন বলে, মানুষ-আকার ভজলে তরবি” – ‘মানুষ-আকার বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? মানুষ-আকার ভজনার সঙ্গে তরবি-র সম্পর্ক কী আলোচনা করো ২+৩=৫

উত্তর ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ রচনার অংশটিতে সাধক-শিষ্য ও ‘মনের মানুষের’ পারস্পরিক সম্পর্ককে বিশেষভাবে বোঝানো হয়েছে। লালন শাহ্ ফকির মনে করেন সাধক সত্তা গুরু সত্তা একাকার। বাউলদের মধ্যে আত্ম বানিজেকে উপলব্ধি করার শক্তি-সত্তা আছে। এই শক্তি-সত্তাকে সাধক-গুরু ভগবানের সঙ্গে এক করে দেখেন। কারণ গুরু সাধনার এমন স্তরে উঠে যান, যেখান থেকে তিনি ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। আসলে পরম বা ভগবান তাঁর সত্তাকে সাধকের মধ্যে একীভূত করে রাখেন ওই মানব-শরীরে। এই জৈব শরীরই ‘মানুষ-আকার’।

সাধক সত্তার দুই রূপ: বাউল সাধনা একই সঙ্গে গুরুবাদী ও আত্মসাধনা। বাউলের নিজের শরীরের মধ্যে যে আত্ম-উপলব্ধিময় সত্তা আছে, তার দুটি ভাগ। একটি মানুষ-গুরু, অন্যটি পরম-গুরু। এই মানুষ-গুরু পরম-গুরুরই প্রতিনিধি। তিনি সাধক-শিষ্যকে সাধনার পথের দিশা নির্দেশ করেন। সুষ্ঠু নির্দেশ দিয়ে পরিচালিত করেন। প্রয়োজনে নিজে উপস্থিত থেকে, শাসন করেন, শিষ্যকে ঠিক পথে নিয়ে আসেন।

মুরশিদের সন্ধান পাওয়া: এই মানুষ-গুরু সাধনার এমন এক স্তরে উন্নীত হন, যেখান থেকে তিনি মনের মানুষ তথা ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। এইভাবে মানুষ-আকার ভজনার মধ্য দিয়ে সাধক-বাউল জাতে ওঠেন। পরম সত্তা বা মুরশিদের সন্ধান পান।

() “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি মানুষ ভজলে কথাটির অর্থ এবং সোনার মানুষ হওয়ার অর্থ কী ? মানুষ ভজা ও সোনার মানুষ হওয়ার মধ্যে বাউলদের কোন্ অভিপ্রায় কাজ করে ? ২+৩=৫

উত্তর

মানুষের ভজনা: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ রচনার ‘মানুষ ভজলে’ কথাটির অর্থ হল মানুষকে ভজনা করা। বাউলদের সাধনা দেহবাদী সাধনা। দেহতে বিরাজ করেন সাঁই বা ভগবান। সেই ভগবানের করুণা পেতে গেলে মানুষকে তথা নিজেকে সাধনা করতে হবে।

সোনার মানুষ: ‘সোনার মানুষ’ হওয়ার অর্থ মনের মানুষ হওয়া। বাউলদের সাধনার উদ্দেশ্য হল পরমের সন্ধান পাওয়া। তা পেতে গেলে দেহের ভিতর গোপন-থাকা মনের মানুষের সন্ধান পেতে হবে।

বাউলদের অভিপ্রায়: বাউল-ফকিরেরা দেহবিহীন আত্মা বা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না। তারা ভাবে, সূক্ষ্ম আলোক-কণার মতো ‘নুর’ থেকে প্রথমে সৃষ্টি হয়েছে মাটি। সেই মাটি থেকে ক্রমশ মানুষসহ অন্যান্য জীব জন্ম নিয়েছে। অলৌকিক কোনো স্রষ্টা নেই। বস্তুর মৌলিক উপাদানগুলির আকস্মিক সম্মিলনে এই জগৎ ও জীবনের উদ্ভব হয়েছে।

আত্মসাধনা: সাধারণ এই মানবদেহের মধ্যেই পরম সাঁইয়ের অবস্থান। সোনার মানুষই মনের মানুষ। এই সোনার মানুষের সন্ধান পেতে হলে দেহধারী মানুষকে আত্মসাধনা করতে হবে। এই মানুষ ভজা ও সোনার মানুষ হওয়ার মধ্যে দিয়েই সাধকের পরমপ্রাপ্তি ঘটে।

() মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।”- মানুষ ছেড়ে শব্দবন্ধটির অর্থ কী এবং ক্ষ্যাপা বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে ? মূল হারানোর বিষয়টি বুঝিয়ে দাও। ৩+২=৫

উত্তর

মানুষ ছেড়ে শব্দবন্ধের অর্থ: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় বলা হয়েছে, বাউলদের সাধনা দেহকেন্দ্রিক সাধনা। সেই পঞ্চভূতের সমন্বয়ে গঠিত রক্তমাংসের শরীরে বিরাজ করেন সাঁইগুরু। সুতরাং আপন দেহকে বাদ দিয়ে সাধনা করলে ভগবানের সন্ধান পাওয়া যাবে না। কেন-না, মানবদেহেই বিশেষরূপে বিরাজ করেন ভগবান। তাঁর কাছে যেতে গেলে দেহকে মূল্য দিতে হবে।

সাধক বাউল : ‘ক্ষ্যাপা’ বলতে সাধক-বাউলকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, এই বাউলরা বিশেষ ভাবের ঘোরে থাকেন। সেই ভাবে এমন মোহিত থাকেন যে সামাজিক আচার-বিচার সম্বন্ধে তাঁদের কোনো খেয়াল থাকে না। ভাবের ঘোরে এঁরা পাগল থাকেন।

মূল হারানো: ‘মূল’ কথাটির অর্থ হল সাধনার লক্ষ্য। বাউলদের সাধনা পরমকে পাওয়ার সাধনা। সেই পরম সাধকের দেহের মধ্যেই অবস্থান করেন। গুরুর দেখানো পথে পাওয়া যায় সেই পরমের সন্ধান। যেহেতু দেহের মধ্যে পরমের অধিষ্ঠান, তাই দেহধারী মানুষকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। অবহেলা করলে মূল তথা সাধনার লক্ষ্য হারিয়ে যাবে।

() “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে দ্বি-দলের মৃণাল এবং সোনার মানুষ বলতে লালন শাহ ফকির কী বুঝিয়েছেন ? দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ কী-ভাবে উজ্জ্বলতা পায়, তা বুঝিয়ে দাও। ২+৩=৫

উত্তর

আজ্ঞাচক্র: ‘দ্বি-দলের মৃণাল’ কথার অর্থ ‘আজ্ঞাচক্র’। অর্থাৎ, পিতৃশক্তি ও মাতৃশক্তির মিলনের ফলে, যে আনন্দ-অনুভূতি উৎপন্ন হয়, তা-ই অন্তরাত্মার স্বরূপ উপলব্ধিতে সাহায্য করে। সেই পরম সত্তার প্রকাশ দ্বি-দলের পদ্মে।

‘সোনার মানুষ’ – ‘সোনার মানুষ’ বলতে ফকির লালন শাহ্ মনের মানুষকে বুঝিয়েছেন।

মনের মানুষ আজ্ঞাচক্রে অবস্থান: সোনার মানুষ বা মনের মানুষ ‘দ্বি-দলের মৃণাল’-এ উজ্জ্বলতা পায়। কেননা, দ্বি-দল মৃণাল বা আজ্ঞাচক্রে পরম বা ভগবান বিরাজমান। সেখানে তাঁর উপস্থিতির উজ্জ্বলতা পুনঃপুন প্রকাশ পায়। সাধক তাই দ্বি-দল মৃণাল ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চান না।

পরম-গুরু : দ্বি-দলের এই মৃণালে স্বয়ং পরম-গুরু বা সাঁই অবস্থান করেন। তাঁর উপস্থিতিতে সাধক পরম-গুরুর উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করতে পারেন। অর্থাৎ মনের মানুষের সন্ধান পান। বাউলের সাধনায় সিদ্ধিলাভের মাধ্যমে সোনার মানুষ উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। সাধক-শিষ্য গুরু-নির্দেশিত সাধনপথে উপলব্ধি করতে পারেন পরম সম্পদ গুরু বা মুরশিদের উজ্জ্বল অস্তিত্ব। বস্তুত, পারিভাষিক এইসব শব্দবন্ধ-‘দ্বি-দলের মৃণাল’-এর মধ্যে আজ্ঞাচক্র, ‘সোনার মানুষ’ ইত্যাদি মনের মানুষের উপস্থিতির সন্ধান ও সাধকের উত্তরণে গুরু-নির্দেশনাসমূহের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

() “মানুষ-গুরু কৃপা হলে জানতে পাবি মানুষ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে এবং মানুষ-গুরুর কৃপা হলে কাকে জানা যাবে ? সে মানুষকে জানতে গুরুর কৃপার প্রয়োজন কেন বুঝিয়ে দাও ৩+২=৫

উত্তর

মানুষ-গুরু: ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ রচনায় ‘মানুষ’ বলতে ‘মানুষ-গুরু’-কে বোঝানো হয়েছে। এই মানুষ-গুরু সাধক-শিষ্যদের ভগবানের দিকে পরিচালনা করেন। পাশাপাশি পরামর্শ দেন লৌকিক ও ব্যাবহারিক বিষয়েও। পুরুষ-প্রকৃতি-বিষয়ক যোগ-সাধনার সময়ও তিনি উপস্থিত থাকেন।

পরমের পরামর্শ: গুরুকৃপা হলে পরম তথা ভগবানকে জানা যাবে। যাঁকে জানা যাবে তিনিই গুরু। তিনিই মুরশিদ। জগতের আরাধনার পরম সম্পদ তিনি। ভগবান যে স্বয়ং – গুরুরূপে শিষ্যকে সাধনপথে পরিচালিত করছেন। লৌকিক ও ব্যাবহারিক নানা বিষয়ে প্রয়োজনমতো পরামর্শ দেন তিনি। কখন কোন্ মুদ্রা সাধনার কোন্ স্তরে অভ্যাস ও অনুশীলন করতে হবে, তাও তিনি জানান।

দিকনির্দেশ: প্রকৃতি-পুরুষ ঘটিত যোগ-সাধনার সময়ও ওই মানুষ-গুরু উপস্থিত থেকে সাধনার দিকনির্দেশ করেন।

গুরুর রূপভেদ: বস্তুত, সাধক-বাউলরা তাঁদের গুরুকে সর্বোচ্চ স্থান দেন। গুরুকে তাঁরা দুটি রূপে দেখেন; মানুষ-গুরুরূপে আর পরমতত্ত্ব বা ভগবানরূপে। মানুষ-গুরু সেই পরম-গুরুর প্রতিনিধি। এই মানুষ-গুরুর প্রতি ভক্তি-নিষ্ঠা না হলে পরমের অনুগ্রহ লাভ হয় না। তাই পরম বা মুরশিদের কৃপা পেতে গেলে ওই মানুষ-গুরুর অনুগ্রহ লাভ করতেই হবে।

() “মানুষ-গুরু কৃপা হলে জানতে পাবি। মানুষ-গুরু বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে ? যাকে জানা যাবে, তার স্বরূপ আলোচনা করো । ২+৩=৫

উত্তর

দেহধারী গুরু: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ অংশে ‘মানুষ-গুরু’ বলতে মানবদেহধারী যে গুরু শিষ্য-সাধককে সাধনার পথ দেখান, তাঁকে বোঝানো হয়েছে। বাংলার বাউল-সাধকেরা তাঁদের সাধনায় গুরুকে সর্বোচ্চ স্থান দেন, এই মানুষ-গুরু সাধকের সামনে রক্তমাংসের দেহ নিয়ে অবস্থান করেন। তাঁর প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা না থাকলে মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে না।

মানব-গুরু ও মুরশিদ অভিন্ন: এই মানুষ-গুরুই পরম-গুরু বা মুরশিদ। জগতের পরম সম্পদ তিনি। কেন-না, তাঁর মধ্যে জায়মান পরম সত্তা ভগবান। সেদিক থেকে তিনি ভগবানের অংশ-বিশেষ। গুরুর রক্তমাংসের মানব শরীরে ভগবান স্বয়ং উপস্থিত থেকে শিষ্যকে পরিচালিত করছেন।

পরামর্শদাতা: লৌকিক ও ব্যাবহারিক বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেন মানুষ-গুরু। কখন, কোন অবস্থায় সাধনার কোন্ মুদ্রা অনুশীলন করতে হবে, সাধক তা জানতে পারেন গুরুর নির্দেশিত পথে। এমনকি, প্রকৃতি-পুরুষ গঠিত যোগ-সাধনার সময়ও এই মানুষ-গুরু উপস্থিত থেকে সাধনার দিনির্দেশ করেন।

আজ্ঞাচক্রের উপস্থিতি: মানুষ-গুরুর মধ্যেই বিরাজমান আজ্ঞাচক্র। তিনিই সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে ভগবানের ঐশী মহিমাকে ধারণ করে আছেন। তাই শিষ্যদের মধ্যে কোনো মনান্তর বা মতান্তর হলে, সেই মত-বিরোধের মীমাংসা তিনিই করেন। যাতে সংকীর্ণ বিভেদ ভুলে সাধক তাঁকে যথাযথভাবে : অনুসরণ করতে পারেন এবং সাধনায় সফল হতে পারেন।

(১০) “এই মানুষে মানুষ গাথা এই মানুষ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে ? সেখানে মানুষ কীভাবে গাথা আছে আলোচনা করো । ২+৩=৫

উত্তর

বাস্তবের বাউল: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ রচনায় ‘এই মানুষ’ বলতে প্রথমত, রক্তমাংসের দেহধারী সাধারণ বাউলদের বোঝানো হয়েছে। আবার যেহেতু পঞ্চভূতে গঠিত মানবদেহেই সাধক-গুরু তথা ‘মানুষ-গুরু’ অবস্থান করেন, সে-কারণে একই সঙ্গে সাধক-গুরুকেও বোঝানো হয়েছে।

পরম জীবসত্তায় নিহিত: বাউল সাধক প্রথমত রক্ত – মাংস তথা পঞ্চভূতের সমন্বয়ে গঠিত জীবসত্তা। সেই সত্তার শরীরে গাথা আছেন মনের মানুষ। সাধারণ বাউল সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে ভগবানের সন্ধান পান। তখন তিনি হয়ে ওঠেন গুরু। আবার এই গুরু তখন আর শুধু গুরু থাকেন না। তিনি হয়ে ওঠেন ভগবানের বিশেষ প্রকাশ রূপ। কেন-না, মানবশরীরের মধ্যেই ভগবানের অস্তিত্ব নিহিত আছে।

গুরুর দুইরূপ: গুরুবাদী সাধক-বাউলদের কাছে গুরু দুটি রূপে সেবিত হন। একটি মানুষ-গুরু, অন্যটি ভগবান। এই মানুষ-গুরু, পরম-গুরুর-ই প্রতিনিধি। এই মানুষ-গুরুর প্রতি ভক্তি বা নিষ্ঠা না জাগলে, সর্বোচ্চ গুরু ভগবানের অনুগ্রহ লাভ হয় না।

গুরুশিষ্যের সম্পর্ক: গুরুশিষ্যের মধ্যে এমন এক বন্ধন জায়মান, যা আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। এই মানুষ-গুরুর মধ্যেই ভগবানরূপে পরম সাঁই বা মুরশিদ বিরাজ করেন। অর্থাৎ ‘গাথা’ থাকেন। গুরুর মধ্যেই ‘মনের মানুষ’ আলোক-উজ্জ্বল হিসেবে অবস্থান করেন।

(১১) “জেনে শুনে মুড়াও মাথা জাতে তরবি। মাথা মুড়ানো কথার অর্থ কী ? জেনেশুনে মাথা মুড়ানোর পরামর্শ রচয়িতা দিয়েছেন কেন ? ২+৩=৫

উত্তর উদ্ধৃত অংশটিতে ‘মাথা মুড়ানো’-র অর্থ সাধনায় নিজেকে সমর্পণ করা। লালন শাহ্ ফকির মনে করেন বাউল সাধনার পথ আপাত সহজ মনে হলেও মূলে তা নয়। সে পথ গভীর ও নির্জন। সাধন-পথের খুঁটিনাটি আগে গুরুর সান্নিধ্য-নির্দেশে জেনে নিতে হবে। যদি মনে হয় যে নির্দেশপথ শিষ্য যথাযথ অনুসরণ করতে পারবে, তবেই বাউল সাধনায় নিজেকে সমর্পণ করা উচিত।

সাধক লালনের জেনেশুনে মাথা মুড়োনোর পরামর্শ দেওয়ার কারণ গুরুবাদী ও দেহবাদী সাধনা: বাউল সাধনা সগুরু দেহকেন্দ্রিক সাধনা। দেহের অভ্যন্তরে পরমারাধ্য সাঁইয়ের অধিষ্ঠান। তাঁর সন্ধান পেতে গেলে সাধককে গভীর সাধনা করতে হবে। সে পথ সহজ নয়। গুরুর সাহচর্যে আগে সাধনার সে পথের খুঁটিনাটি নির্দেশনা জানতে হবে। তারপর মনঃস্থির করতে হবে সে পথে সাধক পা রাখবেন কি না।

স্থির লক্ষ্য: তাই গুরুর নির্দেশ-সাধনায় নেমে সরে আসলে চলবে না। আগে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গুরুই একমাত্র শিষ্যের পথপ্রদর্শক। সনিষ্ঠা পালন করতে হবে সে সাধনপ্রণালী। মাথা মুড়িয়ে, তথা গুরুর আদেশ পালন করে এগিয়ে গেলে গুরুই তাঁকে মনের মানুষের সন্ধান দিতে পারবেন।

মনের মানুষের অবস্থান: মনের মানুষ থাকেন সাধকের জৈবশরীরে। মানুষ-গুরুই সেই পরমের প্রতিনিধি। সাধক-শিষ্য যদি মানুষ-গুরুকে যথাযথ অনুসরণ করতে পারে, তবে সেও একসময় মনের মানুষের সন্ধান পাবে। উঠে যাবে জাতে।

সতর্কতা অবলম্বন: ভেবেচিন্তে এ পথে এগোনো দরকার-এমনই পরামর্শ রচয়িতার।

(১২) ‘লালন শাহ্ ফকিরের গানকবিতাটির বিষয়বস্তু বা মর্মার্থ নিজের ভাষায় লেখো

উত্তর

‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এ বাউল শিরোমণি লালন, বাউল সাধনার যথাযথ পথ নির্দেশ করেছেন। ফকির লালন শাহ্ জানান, মানুষকে সাধনা করলে তবেই সোনার মানুষ হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ বাউলদের সাধনার যে পরম লক্ষ্য মুরশিদের সন্ধান পাওয়া, সেই পরম-গুরু সাধারণ মানবশরীরের মধ্যেই অবস্থান করেন। তিনিই বিশেষরূপে মানুষের রক্তমাংসের শরীরে অধিষ্ঠিত। সেই মানুষ তথা সাধারণ দেহকে অবহেলা করে সাধক খ্যাপা যদি অন্যপথে সাধনার কথা ভাবে, তাহলে সে মনের মানুষের সন্ধান কখনোই পাবে না। সাধনার বিশেষ স্তর-আজ্ঞাচক্র। সেই আজ্ঞাচক্রে বা দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ অর্থাৎ বাউলের মনের মানুষ বা পরম-গুরু-মুরশিদ অবস্থান করেন। সেখানেই তিনি উজ্জ্বলতায় দ্যোতিত হন। কেবলমাত্র মানুষ-গুরু কৃপা হলে তা জানা যাবে। মানুষ-গুরু সেই পরম-গুরুরই প্রতিনিধি।

রক্তমাংসের দেহধারী সাধকশরীরে পরম সাঁই বা মুরশিদ বিরাজ করেন। যেমন স্বর্ণলতা বা আলেক লতার উৎপত্তি বিষয়ে আদি-মধ্য-অন্ত জানা যায় না, তেমনই পরম-গুরুর আদি-অন্ত নেই। পরম-গুরুই আলেক লতা বা আলেক মানুষ। সেই পরমের সন্ধান পেতে গেলে গুরু-বাউলের কাছে দীক্ষা নিতে হবে। বাউল সাধনার খুঁটিনাটি জেনে গুরু-নির্দেশিত পথে যদি নিজেকে সমর্পণ করা যায়, তবেই সাধক-বাউল জাতে উঠতে পারবে। অর্থাৎ পরম-গুরুর সন্ধান পাবে। নিজেও হয়ে উঠবেন মানুষ-গুরু, বাউলসাধনার প্রকৃত স্তরে উন্নীত হবেন। হয়ে উঠবেন জাত-বাউল।

শেষ পঙ্ক্তিতে ফকির লালন শাহ্ বাউল তত্ত্বের মূল দর্শনকে জানিয়েছেন। বাউলদের শরীরের মধ্যে আত্ম বা নিজেকে উপলব্ধি করার চেতনাময় সত্তা আছে। সেই সত্তা আর সাধকের লক্ষ্যের পরমসত্তা ভগবান মূলত একই। একমাত্র গুরু সাধনার এমন স্তরে উঠে যান, যেখান থেকে তিনি ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ স্বয়ং ভগবান তাঁর সত্তাকে সাধকের দেহের সঙ্গে একীভূত করে রাখেন একই মানবদেহে এবং তা একই আকারে। সাধক তার সন্ধান পেলে তবেই পরমের সন্ধান পাবে। তখনই তার ‘সাধনা সিদ্ধিলাভ করবে এবং যে প্রকৃত গুরু হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

ছুটি গল্পের বড়ো প্রশ্ন উত্তর

তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্প প্রশ্ন উত্তর

YouTube – Samim Sir

Leave a Comment